"একুশে ফেব্রুয়ারি"বইটির ভূমিকা: ভূমিকা বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন শুধু এদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নতুন চেতনাপ্রবাহ সৃষ্টি করেছিলাে। এই চেতনা ছিলাে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক মূল্যবােধসঞ্জাত। আমাদের শিল্প সাহিত্যে যারা এই চেতনার ফসল, তাদের ভেতর জহির রায়হানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কারণ ভাষা আন্দোলনে তিনি শুধু যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তা নয়, তাঁর সাহিত্য প্রেরণার মূল উৎস ছিলাে এই আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের উপর প্রথম সার্থক উপন্যাস আরেক ফাল্গুন'-সহ অজস্র ছােটগল্প ও নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। এইসব লেখা এবং তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকার থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ভাষা আন্দোলনের আবেগ, অনুভূতি তাঁকে প্রচণ্ডভাবে আপুত করে রেখেছিলাে। | লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর জহির রায়হান চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন পঞ্চাশ দশকের শেষে। এই শিল্প মাধ্যমটির প্রতি তার যােগাযােগ অবশ্য আরাে আগের। ষাট দশকের শুরুতে জহির রায়হান একজন পরিপূর্ণ চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। কখনাে আসেনি’, কাঁচের দেয়াল নির্মাণের মাধ্যমে। এরপর অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে কয়েকটি বাণিজ্যিক ছবি বানালেও তিনি তার লক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। বাণিজ্যিক ছবি বানাবার সময় তাঁর শিল্পসত্তা যতটুকু বিপর্যস্ত হয়েছিলাে, যে তীব্র মানসিক যাতনার শিকার হয়েছিলেন। তিনি কিছুটা লাঘবের জন্য আবার সাহিত্যের দ্বারস্থ হয়েছেন, উপন্যাস লিখেছেন হাজার বছর ধরে। ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি’ আর কতগুলাে কুকুরের আর্তনাদ'-এর মতাে গল্প লিখে জ্বালা মেটাতে চেয়েছেন। কাচের দেয়াল’ বানাবার পর তিনি একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তবে শিল্পোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়িক দিক থেকে তিনটি অসফল ছবি (কখনাে আসেনি, সােনার কাজল ও কাচের দেয়াল) বানাবার ফলে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী প্রযােজনা করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। বাধ্য হয়ে তাঁকে বাজারচলতি ছবি বানাতে হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে একুশে ফেব্রুয়ারী’ বানাবেন এই ইচ্ছা সব সময় সযত্নে লালন করেছেন তিনি। যখন নিজে চলচ্চিত্র প্রযােজনা করার পর্যায়ে এলেন, তখন বাধা হয়ে দাঁড়ালাে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তাঁর পরিকল্পিত একুশে ফেব্রুয়ারী’ ছিলাে একটি রাজনৈতিক ছবি, আইয়ুবের স্বৈরাচার আমলে সে ধরনের ছবি বানানাে ছিলাে একেবারেই অসম্ভব। এজন্যই তিনি প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে উনসত্তরের গণআন্দোলনের উর্মিমুখর দিনগুলােতে বানিয়েছিলেন জীবন থেকে নেয়া। এ ছবিতে একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরী এবং আন্দোলনের দৃশ্যে জহির রায়হানের রাজনৈতিক আবেগের যে তীব্র প্রকাশ ঘটেছে, বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না ভাষা আন্দোলনের শেকড় তার চেতনার কত গভীরে প্রােথিত। এরপর আরাে বড় ক্যানভাসে সর্বজাতির সর্বকালের আবেদন তুলে ধরতে চেয়েছিলেন ‘লেট দেয়ার বি লাইট’-এ, যে ছবি তিনি শেষ করতে পারেননি। এর কিছুটা আভাষ পাওয়া যাবে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘স্টপ জেনােসাইড’-এ। তবু একুশে ফেব্রুয়ারী নির্মাণের পরিকল্পনা তিনি বাতিল করেননি। '৭২-এর দুর্ঘটনায় এভাবে হারিয়ে না গেলে হয়তাে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বানাতেন তার সেই স্বপ্ন আর আবেগের ছবি। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে জহির রায়হানের অংশগ্রহণ কোন আকস্মিক বা নিছক আবেগতাড়িত ঘটনা ছিলাে না। তাঁর রাজনৈতিক জীবন-প্রবাহের স্বাভাবিক গতি তাকে যুক্ত
বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র জহির রায়হান, যিনি শুধু একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিকই নন, একাধারে ছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যান্য সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারের তুলনায় অগ্রগামী, যার ফলে তাঁর কাজগুলো যুগে যুগে মানুষের দ্বারা হয়েছে প্রশংসিত ও সমাদৃত। ফেনী জেলার সোনাগাজি উপজেলার মজুপুর গ্রামে এই অসামান্য ব্যক্তি ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার নিয়ে তিনি কলকাতায় বাস করলেও ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তাঁরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে চলে আসেন। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে জহির রায়হান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে এখান থেকে স্নাতক পাশ করেন। অসাধারণ প্রতিভাধর এই সাহিত্যিক সাংবাদিকতায় যোগ দিলেও পাশাপাশি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন এবং জহির রায়হান এর বই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। জহির রায়হান এর বই সমূহ এর মধ্যে 'হাজার বছর ধরে' উপন্যাসটি অত্যন্ত পাঠকনন্দিত এবং এর জন্য তিনি 'আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। জহির রায়হান এর বই সমগ্র এর মধ্যে আরো রয়েছে 'আরেক ফাল্গুন', 'শেষ বিকেলের মেয়ে', 'বরফ গলা নদী' ইত্যাদি উপন্যাস এবং 'সোনার হরিণ', 'মহামৃত্যু', 'জন্মান্তর', 'ম্যাসাকার' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তিনি তাঁর ভাই শহীদুল্লাহ্ কায়সার-কে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হন, এবং এরপর আর তাঁর খোঁজ পাওয়া যায়নি কখনো। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'বাংলা একাডেমি পুরস্কার', বাংলাদেশ সরকারের 'স্বাধীনতা পুরস্কার' ইত্যাদি সম্মাননায় ভূষিত হন।