গ্রন্থপরিচিতি: অকপটে নিজেকে বিশ্লেষণ করে তাকে সবার কাছে তুলে ধরার অমোঘ আকাঙ্ক্ষা সবার থাকে না। মাঝে মাঝে যদিও বা বিশ্লেষণের খেয়াল তাড়া করে, তবু তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে পারাই জীবনের ভোগ সুখের সংজ্ঞা কারো কাছে। কিন্তু একে দিনের আলোর মত ছড়িয়ে দিয়ে জীবনকে অবমুক্ত করার চেতনাই মানুষকে কবি করে তোলে কিংবা এমন চেতনার মানুষই বুঝি কবি হন! কবি হয়ত মানুষ নন, কেননা, মানুষের তো লুকোনোর দায় থেকে যায়। কবি শামীম আহমেদ কতটা কবি অথবা শুধুই মানুষ কিনা, সেই বিশ্লেষণ দুরূহ। একফোঁটা বৃষ্টি হতে যদি কাব্যগ্রন্থে পাপ-পূণ্যের বাইরেও জীবনের নিজস্ব গতি ও খেয়াল আছে, সেই ভাবনাকে আগলে চলার স্পৃহা প্রকাশিত হয়েছে, এমনটা নির্দ্বিধায় বলা যায়! জীবনকে অতটা সরল রেখায় চলতে দেওয়ার সাহস তো সাধারণ মানুষের থাকেনা, থাকে কবির, যা ঠাই পায় তাঁর সৃষ্টিশীল কাব্যের পঙক্তিমালায়। শামীম আহমেদ এবং তাঁর কবিতা তাই পাপ-পূণ্যের বাইরে চলা জীবনের নিজস্ব গতিময়তা ও খেয়ালেরই প্রতিচ্ছবি।
মুখবন্ধঃ আমার কিছু কবিতার জন্ম ঘোরের মধ্যে। জ্বর হলে যেমন মনে হয় - কেমন একটা অস্বস্তি, অনিশ্চয়তা! মনে হয় একটা অদ্ভুত একটা পিছুটান ধরে রাখে আমাকে। আমি তখন ছায়ার মতোই অনুসরণ করতে থাকি কবিতার চরিত্রগুলোকে। মানুষের নষ্টালজিয়াও ঠিক এমনটি হয়, মনের মাঝের অন্ধ গলিতে ঘুরে বেড়ায় প্রেমের আলো হয়ে। আমাদের জীবনের সব চাওয়া কিন্তু পাওয়া হয়ে ওঠেনা, সেই অপূর্ণতা ফুটে উঠেছে কিছু কবিতায়। মানুষ নিজেকে যতোটা গুছিয়ে কষ্ট দিতে পারে তা বোধহয় আর কোন প্রাণী পারেনা। যেখানে কষ্ট না দিয়েও থাকা যায়, ভালোবাসায় হারিয়ে যাওয়া যায় ইচ্ছামতো, সেখানেও মানুষ কষ্টকে বেছে নেয় - দুঃখবিলাসী হয়। অনেক গল্পের পেছনে কবিতা থাকে। আমার অনেক কবিতার পেছনে কিছু গল্প আছে, আছে কিছু মানুষও। কিছু কবিতা লেখা হয়েছে কিছু মানুষ, তাদের সাথে কথোপকথন কিংবা কোন একটি বিষয়ে দু’জনের বোঝাপড়া কিংবা তীব্র বিবাদ, অথবা বিরহের জায়গা থেকে। আবার কিছু কবিতার জন্ম বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা থেকে। সেইসব আলোচনায় যেমন এসেছে পূর্ণিমা, পাহাড়, জ্যোৎস্নার, স্বপ্নবিলাস কিংবা নগ্ন নারীর কথা তেমনি এসেছে সাম্রাজ্যবাদ, শোষনতন্ত্র, ত্রিতত্ববাদ, দ্রোহকাল এমনকি তুলনামূলক ধর্মতত্বও। এমন কিছু মানুষের কথা দ্বিতীয় কোন চিন্তা ব্যতিরেকেই লিখে ফেলা যায় - তানজিনা, তারেক ভাই, রবিন, সায়ীদ ভাই, সঞ্জয়’দা, গৌতম’দা, মাহফুজ ভাই, হাসনাত ভাই; ধন্যবাদ আপনাদের। আরো অনেকে আছেন যাদের কথাই বেশি লিখতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তারা অনুচ্চারিতই থাক, তাদের খুঁজে নেবেন কবিতার ভেতরে। আমার বাবা-মা’র কথা একটু বলি – মধ্যবিত্ত সংসারে থেকেও কখনো বই কিনতে বা পড়তে অনুৎসাহিত করেননি। আমাদের কখনোই অনেক টাকা ছিলোনা, কিন্তু ঘর ভর্তি বই ছিলো; এখনও আছে। লেখালেখির অভ্যাস অনেক আগের, ছোটকাল থেকেই। এই যে এভাবে পড়তে পড়তে, লিখতে লিখতে কবি হয়ে ওঠা তার জন্য বাবা-মা’র অবদান অসীম। আমি খুব হালকা করেই সবাইকে বলি আমার ১৪ বছরের দাম্পত্য জীবন। বিয়ের আগে এবং পরে ৭ বছর করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র ছিলাম, কিন্তু ক্লাস করবার কিংবা শিখবার জন্য একদিনও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি বলে মনে পড়েনা। এখনকার চাইতেও তখন ঔদ্ধত্য আরো বেশি ছিলো, মনে হতো ক্লাসে আর কি শেখাবে! যতদিনই গিয়েছি তার কারণ একটাই - প্রেমময়ী স্ত্রী, আফরোজা হুসাইন। এই বইয়ের বেশিরভাগ কবিতা গভীর রাত জেগে লেখা। তার অনুপ্রেরণা ও প্রশ্রয় ছাড়া হয়তো কখনোই আমার কবি হয়ে ওঠা হতো না। আমার একমাত্র কন্যা ওয়ামিয়া’র জন্মের পর আমার সংসারের প্রতি বন্ধন আরো বেড়েছে, সাথে কবিতার প্রতি প্রেমও! আমার এই প্রয়াস মায়াময় বাঁধনে জড়িয়ে থাকা এ মানুষগুলোর জন্য। কবি হলে নাকি বৈরাগী হতে হয়, সমাজ-সংসার ছেড়ে চলে যেতে হয়! কেন বলে আমি জানিনা! একটা কারণ হতে পারে ভালোবাসা নিয়ে অস্পষ্টতার অন্ত নেই। দ্বিধার বেড়াজালে কেটে যায় জীবনের অবিশ্বাস্য মুহুর্তগুলো। মানুষ তো যন্ত্র নয়, ভালোলাগাকে থমকে দিতে পারেনা যেমন তেমন করে, তার মনের সাথে যুদ্ধ করতে হয়, লড়তে হয় সমাজের সাথে, সংসারের সাথে। জীবন সায়াহ্নে যখন যুদ্ধ শেষ হয়, মানুষের উপলব্ধি হয় সমাজ এবং সংসার নামের মানবসৃষ্ট সম্পর্কগুলোকে খুশী করতে গিয়ে হেরেছে সে নিজে। দেরিতে আসে বুঝি, তবু এমন উপলব্ধির মাঝেই লেখা আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একফোঁটা বৃষ্টি হতে যদি’।
কবি পরিচিতিঃ বাস্তব-অবাস্তবের মিথস্ক্রিয়া, সমাজের আপাতঃ দোদুল্যমানতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এ ছাত্রকে করেছে কবি। তাঁর কাব্যচিন্তাকে করেছে দৈনন্দিন জীবনের রূপকথা। ত্রিশোর্ধব তরুণ এ কবি নিজের কবিতাকে তাই মেনেছেন অলৌকিক লৌকিকতা বলে। সরকারি কর্মকর্তা বাবার কল্যাণে কৈশোরেই পরিচিতি ঘটেছে অনেক বৈচিত্র্যময় মানুষ আর ভিন্ন পারিপার্শ্বিকতার সাথে। সে সুবাদে সমাজ ও ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণে তাঁর এ অনন্য যোগ্যতা অর্জন। ভিন্ন জীবনদর্শন, রূঢ় বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসির ইতিবৃত্তগুলোকে এক সুতোয় কত সহজে গেঁথে ফেলা যায় তা তাঁর শক্তিশালী লেখনীর মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়েছে। পেশাগত জীবনে একজন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ কবি শামীম আহমেদ সুখ খোঁজেন ভালোবাসার পঙতিমালায়।
জন্ম, মৃত্যু, স্থান, কালের ব্যাপ্তিতে জীবনকে বাধতে চান না। মনে করেন সময়ের সাথে জীবনের উপলব্ধির পরিভ্রমণ ঘটে। চলতে থাকা পথে দিকভ্রান্ত কবি ঠাহর করতে পারেন না বাস্তব-অবাস্তবের ভিন্নতা, তাই সুখ খুজে ফেরেন দুঃখের পংক্তিমালায়।