অরণ্যানী পড়তে পড়তে মনে হবে পাঠক একটা ভ্রমণকাহিনি পড়ছেন; কখনো মনে হবে এটা একটা অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি। মনে হতে পারে অতিপ্রাকৃত ঘটনার বর্ণনা কিংবা রহস্যের কুহেলি আচ্ছন্ন এক রহস্যময় উপন্যাস। এত কিছু ভেবে, খুব ঘোর লাগা মনস্কতায় পড়তে পড়তে উপন্যাস যখন যবনিকায় আসে তখন পাঠক ঔপন্যাসিককে আবিষ্কার করে ফেলবেন একজন চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী হিসেবে। যদিও উপন্যাস গ্রন্থের প্রচ্ছদপত্রে প্রকাশিত পরিচিতি থেকে ঔপন্যাসিক আল হেলাল আজাদীকে করপোরেট কালচারের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী পদে দেখতে পাই। থমথমে মনোযোগ আকর্ষণের পরিচ্ছন্ন প্রচ্ছদের ‘অরণ্যানী’ প্রথমেই আমাদের ভাবতে শেখায়Ñঅরণ্যানী হয়তো বিভ‚তি-অনুভ‚তির ‘আরণ্যক’ স্বাদের কোনো সৃষ্টি। আসলেও তাই, উপন্যাস পাঠে আমরা লেখককে খুঁজে পাই বিভ‚তিভ‚ষণ বন্দ্যোপাধ্যাায়ের মতো বনচারী, বনপ্রেমী, বৃক্ষপ্রেমী হিসেবে। যদিও ‘অরণ্যানী’র চরিত্রগুলো স্বপ্ন-বাস্তবতা আর ‘আরণ্যক’ হলো লেখকের যাপিত জীবনের চিত্র। ‘অরণ্যানী’র নামকরণের উৎস খুঁজতে পাঠককে প্রায় অর্ধেক বইয়ে অগ্রসর হতে হবে। সেখানে বর্ণিত হয়েছে : “মাঝে মাঝে বিকেল হলে গ্রামের দিকে চলে যাই।...প্রায় দশ বর্গকিলোমিটার জুড়ে এ বনাঞ্চল। অঞ্চল ভেদে এক একটির নাম এক এক কিন্তু সম্পূর্ণটার নাম ‘অরণ্যানী’।...অরণ্যানী বলতে যে অংশকে বোঝায় তা হলো গভীর অরণ্যে যে অংশ। কেউ কখনোই এর গভীরে যায় না।” খুব আবেগী বর্ণনা। কখনো লেখক বনের মানুষ টারজান, কখনো ন্যাশনাল জিওগ্রাফির সারভাইব দলের সদস্য, কখনো তিনি শার্লক হোমসের মতো ওভারকোটধারী গোয়েন্দা। উপন্যাসজুড়ে আছে করপোরেট কালচারের প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের চর্চা। যেখানে লেখককে তার নিয়োগকর্তা বলছেন, ‘শুনলাম আপনি অসুস্থ অথচ এখনো অফিস করছেন।’ ‘অরণ্যানী’র বর্ণনাভঙ্গি উত্তম পুরুষে। এখানে লেখক নিজেই কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে উঠেছেন। তাকে সারাবন, বনানী, অরণ্য, পাহাড়ি এলাকায় চরিয়ে বেড়াচ্ছে তারই ছাত্রজীবনের সাথি চঞ্চলা ‘ম’। সারা উপন্যাসে মুখ্য হয়ে আছে ‘ম’র অতিপ্রাকৃত আচরণ, যে কিনা কখনোই লেখকের মুখোমুখি হয়ে কথা বলে না। উপন্যাসে আছে সমাজের বিবিধ চিত্র : বহুবিবাহ দর্শন, হেরেম ভাবনা, সন্তান, চরিত্র, আমলাতন্ত্র, অফিসের ক্লার্ক-কালচার, একটা প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বশীলতা, ধর্মবোধ, যাপিত জীবন, মননে ও বিশ্বাসে সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতা। সর্বোপরি আপন সংসার প্রভৃতি বিষয়াদি। ‘অরণ্যানী’র বর্ণনার চ‚ড়ান্তে আমরা উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে একটি হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ারে পাই। একটা গাড়ি দুর্ঘটনার পর এখানেই সে শুয়ে ছিল দিন কয়েক। জ্ঞান ফিরলে সে তার অরণ্যানী থেকে ঘরসংসারের বাস্তবতায় ফিরে আসে। চিকিৎসকগণ তার এই অরণ্যবাস ও ঘটে যাওয়া সবকিছুর কারণকে ‘সাইক্লি অব উইলস ব্রেইন ইনট্রেনাল হেমারেজ’ বলে উল্লেখ করলেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণত কেউ ৭২ ঘণ্টার বেশি বেঁচে থাকে না। তবে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র এই ৭২ ঘণ্টায় বিগত পাঁচ বছরের ঘটনার স্মৃতিদর্শন শেষে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে। তাই তার কৃতজ্ঞতা : ‘মাছের পেটে একজন নবী স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে করে চল্লিশ দিন পর ফের জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। আমি সেইভাবে স্রষ্টাকে স্মরণ করার চেষ্টা করছি।’ উপন্যাসের দার্শনিক মাহাত্ম্য এভাবেই পাঠককে বিমুগ্ধ করবে। পাঠকের সংসারপ্রিয়তা, কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতা ও সমাজ ভাবনাও জেগে উঠতে পারে অকৃত্রিমভাবে। সে জন্য উপন্যাসটির বিপুল পাঠক প্রয়োজন।