"সিন্ধুর এক বিন্দু" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: আকাশচুম্বী তারকাখ্যাতি যার ভাগ্যে জুটেছে তাঁর আত্মজীবনীই পাঠক আগ্রহ নিয়ে পড়ে থাকেন। অধ্যাপক গােলাম সামদানী কোরায়শী জীবদ্দশায় ও মৃত্যুর পরও যার ভাগ্যে তারকাখ্যাতি জোটেনি, অথচ মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা পেয়েছিলেন অগাধ। তাঁর আত্মজৈবনিক রচনা ‘সিন্ধুর এক বিন্দু পাঠক কেন পড়বেন, খ্যাতির বিবেচনায় এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। একজন আলােকিত মানুষের লেখনীতে এই রচনাটি তিরিশ দশকের শুরু থেকে। নব্বই-এর সূচনালগ্ন পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার একটি প্রামাণ্য প্রতিবিম্ব। নিজের জীবন-গল্পকে তিনি এই উচ্চতায় তুলে নিতে সক্ষম হয়েছেন, কারণ জীবনের বন্ধুর পথে নগ্নপদযাত্রা শুরু করলেও অনড় আদর্শিক অবস্থান এবং শুদ্ধতার সৌন্দর্যে জীবনকে সাজাতেও পেরেছিলেন তিনি। অন্ধকারাচছন্ন সামাজিক পরিবেশে একটি বিধ্বস্ত পরিবারে একজন শিক্ষিত পিতার ঔরসে জন্মগ্রহণ করেও শিক্ষার আলােকবঞ্চিত কৈশােরে একজন পরাশ্রিত রাখাল হিসাবে তাঁর জীবন শুরু। এরপর সনাতনী মাদ্রাসা শিক্ষা নিয়েও প্রগতিশীলতা ও মুক্তবুদ্ধির চর্চায় আজীবন নিরলস ছিলেন তিনি। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র সাথে সহকারী সম্পাদক হিসেবে প্রণয়ন করেন বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান, অনেকগুলাে ভাষায় দক্ষতা নিয়ে অনুবাদ করেন ‘আল-মুকাদ্দিমা' সহ অনেক মূল্যবান গ্রন্থ; প্রবন্ধ-উপন্যাস-শিশুসাহিত্য প্রভৃতি মৌলিক রচনা সমূহে ছড়িয়ে দিলেন মূল্যবান চিন্তাধারা—এভাবে বিদ্যাজগতে তাঁর কর্ম অধিষ্ঠান। বুদ্ধিজীবী সগ্রাম শিবির (মুক্তিযুদ্ধ কালীন), সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী, বাংলাদেশ কলেজ| বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সহ অসংখ্য সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত থেকে, নেতৃত্ব দিয়ে সামাজিক দায়িত্বও পালন করেছেন নিষ্ঠা ও দক্ষতার সাথে। ধর্মকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত টাইটেল পাশ মৌলানা থেকে যার উত্তরণ ঘটলাে একজন ধর্মনিরপেক্ষ মুক্তবুদ্ধির মানুষে, আরজ আলী মাতুব্বর থেকে জঁ পল সার্জে, এঁদের কাতারে দাঁড়িয়ে যিনি উপলব্ধি করলেন জীবনকে—এরকম একটি জীবনের বিকাশ বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যাবে এ-গ্রন্থে। সমস্ত দ্বিধা দ্বন্ধ কাটিয়ে সচেতন ঋদ্ধ পাঠককে পড়তেই হবে ‘সিন্ধর এক বিন্দু’—তাঁর নিজের স্বার্থেই। সিন্ধুর এক বিন্দু পাঠে পাঠক গােলাম সামদানী কোরায়শীকে যতােটা জানবেন, ঠিক ততােটাই জানবেন তাঁর সময়কে। তিনি তাঁর পরিপার্শ্ব, সমাজ, পরিবার, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-মূল্যবােধ এবং দেশ ও রাজনীতিকে সুখপাঠ্য ঋজু ভাষায় চিত্রায়িত করেছেন ‘সিন্ধুর এক বিন্দুতে অপূর্ব মুন্সিয়ানায় । ১৯২৯ থেকে ১৯৯১-প্রায় বাষট্টি বছরের দীর্ঘ বৈচিত্র্যময় জীবন নিয়ে আত্মজীবনী রচনায় হাত দিয়েছিলেন একেবারে শেষ জীবনে । শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, চিন্তাজীবন তিন খণ্ডে আত্মজীবনী লেখার পরিকল্পনা থাকলেও ‘চিন্তাজীবন শুরু করতে পারেননি। গােলাম সামদানী কোরায়শীর আত্মজীবনী ‘সিন্ধুর এক বিন্দু তাই আমাদের সামাজিক ইতিহাসের এক মূল্যবান দলিল, সচেতন অগ্রসর পাঠকের আকাঙ্ক্ষার গ্রন্থ-একটি প্রয়ােজনীয় পাঠ উপাদান।
তিনি ১৯২৯ সালের এই দিনে বর্তমান নেত্রকোনার কেন্দুয়ার কাউরাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ সালে ঢাকা আলিয়া মাদরাসা থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানে এমএ (কামিল) পাস করেন। এরপর তিনি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ১৯৫৯ সালে বাংলায় অনার্স ও ১৯৬০ সালে এমএ পাস করেন। সামদানী প্রথমদিকে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি ড. মু. শহীদুল্লার সম্পাদনা সহকারী, পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক ভাষার অভিধান প্রকল্প ও পাণ্ডুলিপি ও সংকলন বিভাগ, বাংলা একাডেমিতে (১৯৬১-৬৮) কাজ করেন। বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে (১৯৬৮-৯১) নিযুক্ত হন। সামদানী কোরায়শী অসংখ্য রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বঙ্গবন্ধু পরিষদ, ময়মনসিংহ সাহিত্য পরিষদ, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, মাদরাসায়ে আলিয়া, বাংলা সমিতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। তিনি এসব সংগঠনের বিভিন্ন দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সদস্য ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন। গোলাম সামদানীর মৌলিক রচনার পাশাপাশি অনুবাদ ও সম্পাদনার পরিমাণও বিশাল। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো সাপ্তাহিক ময়মনসিংহ বার্তা। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীদের তার লেখা প্রকাশ হয়। তিনি ৬টি জীবনী ও আত্মজীবিনী, ৫টি উপন্যাস, ৩৬টিরও বেশি গল্প ও গল্প সংকলন, ১০টি নাটক, ৫টি কবিতা সংকলন ও কবিতা, ৪০টি ছড়ার সংকলন, ৬৫টি গানের সংকলন, ২১টি অনুবাদ ও অনেক সম্পাদনা করেন। গোলাম সামদানী কোরায়শী অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। তিনি ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’-২০১৭ লাভ করেন। ১৯৯১ সালের ১১ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।