"পিঙ্গল আকাশ" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: উপন্যাসের নায়ক মঞ্জু, তার নিজস্ব বয়ানে কাহিনি বেড়ে উঠেছে। তার জীবন সংগ্রামই এই কাহিনির মূল বিষয়বস্তু। শৈশবে পিতৃহীন কাহিনির নায়ক মঞ্জু, কিন্তু মা ছিলেন। ভােগবাদী এক নারী, যে নতুন আরেকটি বিয়ে করেছে, এবং তারপরেও অন্য পুরুষে তাঁর আসক্তি। এসব ঘটনা খুব কাছ থেকে দেখেছে মঞ্জু, ফলে সে পরিণত হয়েছিল একটি পরগাছায়। তারপরও যাদের ভালােবাসা ও স্নেহে বেড়ে উঠতে চেয়েছিল সে, তারাও ছিল আত্ম-উন্নয়নে মশগুল। মঞ্জু যে পরিবেশে বাস করছিল, সে পরিবেশ ছিল পুরুষ প্রধান, কিন্তু ঘটনাবলি নিয়ন্ত্রণ করছে নারীরা। এটা একটা বিরূপ পরিস্থিতি যা থেকে মুক্তি খুঁজে বেড়ায় মঞ্জু। কারণ চারপাশের যেসব মানুষগুলােকে পেয়েছে সে, তারা প্রায় সবাই কঠিন হৃদয়ের মানুষ। কিন্তু মঞ্জু খুঁজে ফিরছিল ভালােবাসা, স্নেহ, মমতা। ফলে সে একা হয়ে যায় এ পৃথিবীতে। উপন্যাসটি মঞ্জুর জীবনের এই আত্মদ্বন্দ্ব ও বেদনার চিরায়ত এক রূপের বর্ণিল ছটা। প্রথম উপন্যাসেই শওকত আলী এভাবে পাঠক ও সুধীসমাজে বলিষ্ঠ এক দ্বান্দ্বিক কাহিনি নিয়ে এসে আলােড়ন তুলেছিলেন। ষাটের দশকের প্রথমার্ধে বাঙালি মুসলমান লেখকরা যখন সবেমাত্র চারাগাছের মতাে লেখালেখির জগতে পরিস্ফুটিত হচ্ছেন, তখনকার পরিবেশে এ আত্মদ্বান্দ্বিক উপন্যাস যৌক্তিক কারণেই বাংলা কথাসাহিত্যে স্থান করে নিতে সমর্থ হয়েছিল।
শওকত আলীর (জন্ম: ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ - ২৫ জানুয়ারি, ২০১৮)। জন্মস্থান পশ্চিম বাংলার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ। স্কুলের পড়াশোনা শ্ৰীরামপুর ও রায়গঞ্জে। দেশ-বিভাগের চার বছর পর তাঁর চিকিৎসক পিতা সপরিবারে দিনাজপুর শহরে চলে এলে শওকত আলী সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কলেজ শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন। ঢাকার জগন্নাথ কলেজে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে দীর্ঘ পাঁচিশ বছর অধ্যাপনা করার পর বর্তমানে তিনি সরকারী সংগীত মহাবিদ্যালয়ে অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত। একটি ছোট উপন্যাস ‘পিঙ্গল আকাশ” (১৯৬৪) তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। এর পর প্রকাশিত হয়েছে। দুটি ছােটগল্প সংকলন ও একটি উপন্যাস। শিশুকিশোরদের জন্যেও তিনি লিখে থাকেন। বাংলা ছোটগল্পে বিশেষ অবদান রাখার জন্য শওকত আলী বাঙলা একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৬৮ সালে। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির তাঁকে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে। এ ছাড়াও তাঁকে ১৯৮৩ সালে অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ফিলিপূস সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯০ সালে রাষ্টিয় পুরস্কার ২১শের পদকে ভূষিত করা হয়। নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসে তাঁর আগ্ৰহ অত্যন্ত গভীর। বাংলার প্রায়—লুপ্ত ও ঝাপসা ইতিহাসে তাঁর সৃজনশী অনুসন্ধান আমাদের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে।