দেশে ও বিদেশে এ-যাবৎ প্রকাশিত কোরানের বিভিন্ন অনুবাদের তুলনামূলক পাঠ এবং তাঁর দীর্ঘ অভিধানচর্চার অভিজ্ঞতা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকৃত কোরানের এই সরল বিশ্বস্ত অনুবাদ
"কোরান শরিফ : সরল বঙ্গানুবাদ" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: ধর্মগ্রন্থ হিসেবে পবিত্র কোরানের বাণী চিরন্তন। কিন্তু ভাষা নিত্য বিবর্তনশীল। ফলে প্রতি যুগেই সে-যুগের উপযােগী ও বােধগম্য ভাষায় মহাগ্রন্থের নতুন ও নির্ভরযােগ্য অনুবাদের প্রয়ােজন রয়েই যায়। কোরান অবতীর্ণ হয়েছিল আরবিতে। বলাবাহুল্য আরবি ও বাংলা ভাষার মেজাজ এক নয়। বাক্যগঠনরীতি বা বাকভঙ্গিতেও রয়েছে স্বাতন্ত্র। উপমা-উৎপ্রেক্ষাযমক ব্যবহারের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। উপরন্তু কোরানের ভাষা ক্লাসিকধর্মী, অলঙ্কারবহুল। ফলে আক্ষরিক অনুবাদের সাহায্যে অনেক সময়ই বাচ্যার্থ ছাড়িয়ে মর্মার্থে পৌছানাে সম্ভব হয় না। অথচ কোরানেই বারবার এর আয়াতের অর্থ উপলব্ধি ও তা হৃদয়ঙ্গম করার ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় যেমন তেমনি বাংলা। ভাষায়ও এ-পর্যন্ত বহুবার এ-মহাগ্রন্থের অনুবাদ হয়েছে। গিরিশচন্দ্র সেন, মােহাম্মদ আকরম খা, আবুল ফজল, কাজী আবদুল ওদুদ প্রমুখ অনেক খ্যাতজনই কোরানের আংশিক বা পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেছেন। এসব অনুবাদও তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। নানা তাৎপর্যে মণ্ডিত। তারপরও একালের বাংলাভাষী পাঠকের জন্য কোরানের একটি সহজ, মূলানুগ ও পূর্ণাঙ্গ। অনুবাদের প্রয়ােজন অনেকদিন ধরেই অনুভূত হয়ে আসছিল। ইতিপূর্বে মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সংকলিত কোরানসূত্রগ্রন্থটির প্রকাশ। পাঠকের এ-প্রত্যাশাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আসলেও আধুনিক ভাষাজ্ঞান, যুগ ও জীবনচেতনা, সর্বোপরি এক এনসাইক্লোপেডিক মন নিয়ে তার চেয়ে যােগ্য ব্যক্তি এ-কাজের জন্য আমাদের দেশে এ-সময়ে আর কে হতে পারতেন! দেশে ও বিদেশে এ-যাবৎ প্রকাশিত কোরানের বিভিন্ন অনুবাদের তুলনামূলক পাঠ এবং তাঁর দীর্ঘ অভিধানচর্চার অভিজ্ঞতা মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকৃত কোরানের এই সরল বিশ্বস্ত অনুবাদটিকে আলাদা মূল্য দিয়েছে।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বাংলাদেশের একজন অন্যতম শিক্ষাবিদ, আইনজীবী ও বিচারক। ১৯২৮ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী মুহাম্মদ জহির উদ্দীন ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী এবং আইনজীবী। শৈশব থেকেই রাজনৈতিক বিষয়াদি ও সংস্কৃতির দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পর তাঁরা তৎকালীন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও পরবর্তীতে রাজশাহীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে বি.এ. (সম্মান) এবং ১৯৫১ সালে এম.এ. পাস করেন। এরপর ১৯৫৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ইতিহাস বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন। তাঁর কর্মজীবনের শুরু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পদে যোগ দিয়ে। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে শুরু হয় এক নতুন অধ্যায়ের। সহকারী এডভোকেট জেনারেল, হাইকোর্টের ভাইস প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য পদে দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৭৬ সালে তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি হন। ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলাকালীন তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান একাধারে একজন আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ এবং অভিধানপ্রণেতা। তিনি একজন ভাষা সৈনিক; ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর বই সমূহ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ। তিনি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের বই সমূহ হলো ‘রবীন্দ্র সম্বন্ধে সঞ্জনা ও পার্থক্য বিচার (১৯৬৮)’, ‘যথা-শব্দ (১৯৭৪)’, ‘কোরআন সূত্র (১৯৮৪)’, ‘ভাষার আপন পর (২০১২)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি। সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কৃতিত্বের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরষ্কার (১৯৮৪), একুশে পদক (২০০৭) সহ আরো বেশ কিছু সম্মাননায় ভূষিত হন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এর বই সমগ্র পাঠকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।