জীবদ্দশাতে সুকান্তর কোনও বই-ই প্রকাশিত হয়নি। ‘ছাড়পত্র’, ‘পূর্বাভাস’, ‘ঘুম নেই’, ‘মিঠেকড়া’, ‘হরতাল’, ‘অভিযান’ ও ‘গীতিগুচ্ছ’—প্রকাশিত সবক’টি গ্রন্থ শুধু নয়, অগ্রন্থিত রচনা, সারস্বত লাইব্রেরির সুকান্ত সমগ্রেও নেই এমন কিছু রচনা একত্রিত করে যথার্থ অর্থে ‘সুকান্ত সমগ্র’ প্রকাশিত হল। প্রসঙ্গত জানাই, আমরা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি প্রবর্তিত বানানবিধি যথাসম্ভব মেনে চলার চেষ্টা করেছি। যেসব কবিতার পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, পাণ্ডুলিপি অনুসরণ করে সেগুলির যথাযথ পাঠ ছাপা হয়েছে। পাঠান্তর-প্রসঙ্গে পৃথক একটি আলোচনাও রয়েছে। অজস্র পাদটীকা, প্রাসঙ্গিক তথ্য, ব্যক্তি- পরিচিতি দেওয়া হল। দুষ্প্রাপ্য ছবি, পাণ্ডুলিপির প্রচুর ফোটোকপি―নিশ্চয়ই পত্র ভারতীর এই সংস্করণটিকে সমৃদ্ধ করবে। আমরা বিশ্বাস করি, সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবিটি এর মূল্যবান সংযোজন হিসাবে পাঠকের কাছে বিবেচিত হবে। সত্যজিৎ ‘সুকান্ত-নামা’ বইয়ের জন্য এঁকেছিলেন এটি। সত্যজিৎ-চর্চায় নিবেদিতপ্রাণ আজকাল-গ্রন্থাগারিক দেবাশিস মুখোপাধ্যায় তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে মহামূল্যবান এই ছবিটি দিয়েছেন। সুকান্ত- নামা-য় সত্যজিৎ রায়ের নাম ছিল না। পরবর্তীকালে দেবাশিসবাবুর কাছে এই ছবিটি দেখে ভারি খুশি হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়।
বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি। ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করেন। পিতা-নিবারন ভট্টাচার্য, মা-সুনীতি দেবী। মাতামহের ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের বাড়ীতে,কালীঘাট,কলকাতায় তার জন্ম।। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার, বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার, উনশিয়া গ্রামে। এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম। বেলেঘাটা দেশবন্ধ স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুনাচল বসু। সুকান্ত সমগ্রতে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলির বেশিরভাগই অরুনাচল বসুকে লেখা। অরুনাচল বসুর মাতা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রস্নেহে দেখতেন। সুকান্তের ছেলেবেলায় মাতৃহারা হলেও সরলা বসু তাকে সেই অভাব কিছুটা পুরন করে দিতেন। কবির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটার ৩৪ হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়ীতে। সেই বাড়িটি এখনো অক্ষত আছে। পাশের বাড়ীটিতে এখনো বসবাস করেন সুকান্তের একমাত্র জীবিত ভাই বিভাস ভট্টাচার্য। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্তের নিজের ভাতুষ্পুত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মম্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রাসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপোসহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমুনিষ্ট পার্টির সারাক্ষণের কর্মী। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করলেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথম ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলিকাতার ১১৯ লাউডট ট্রিষ্ট্রের রেড এড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন মাত্র মাত্র ২১ বছরের আর লেখালেখি করেন মাত্র ৬/৭ বছর। সামান্য এই সময়ে নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী।