ভূমিকা হাজার বছর বাংলা গান বিবর্তিত ও বিকশিত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে ও যুগোপযোগী গানের সুরে পরিবর্তন এসেছে, কখনো রাগসংগীতের সঙ্গে লোকসংগীতের আবার পাশ্চত্য গীতরীতি ও বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয় ঘটেছে। তথাপি বাংলা গান প্রধানত কথা ও সুরের যুগল মিলনের পথ ধরেই বিকাশ লাভ করেছে এবং মুলত একরৈখিক পথে মেলোডি-ধর্মিতাকে প্রাধান্য দিয়েছে। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে বাংলা গানের ক্ষেত্রে আমারা সমৃদ্ধরূপ লক্ষ্য করি রামনিধি গুপ্ত বা নিধু বাবু থেকে গুরু করে বাংলা সাহিত্য-সংগীতের অন্যতম পঞ্চ-প্রধান কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), রজনীকান্ত সেন (১৮৬৪-১৯১০), অতুলপ্রসাধ সেন (১৮৭১-১৯৪১) এবং কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)রচিত গানে এবং বলাই বাহুল্য এই পঞ্চ-প্রধান কবির গান স্বকীয় মহিমায় উজ্জ্বল বলে প্রত্যেকের গানের স্বতন্ত্র মহিমা রয়েছে। এই গানগুলো কি আধুনিক? এমন কথা মনে জাগতে পারে। কোন গান আধুনিক আর কোন্ গান আধুনিক নয় এ নিয়ে বিতর্ক এবং মতান্তর আছে। এখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলার অবকাশ নেই। সাধারণভাবে বাংলায় আধুনিক গান বলতে ধরে নেয়া হয় যে, রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী অথার্ৎ বিশশতকের চল্লিশ দশক থেকে যে গান গীতিকার-সুরকারের সমন্বয়ে সৃষ্ট তাকেই আধুনিক গান হিসেবে অভিহিত করি। এর একটি প্রেক্ষাপট আছে। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচার-প্রসারে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নব নব উদ্ভাবনে বর্তমানে গণমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।একদিকে বাংলা চলচ্চিত্র, অন্যদিকে গ্রামোফোন কোম্পানি ও বেতার টেলিভিশনের জন্য গীত রচনা ও রেকর্ডিং এর এক প্রবল স্রোতধারা লক্ষ্য করা গেল প্রধানত তিরিশের দশক থেকে।কেবল রবীন্দ্র-নজরুলের গান নয়, তাদেরই অনুসৃত পথে একঝাঁক গীতিকার-সুরকার শিল্পী এগিয়ে এলেন বাংলা গানের জগতে। প্রকৃত পক্ষে, নজরুল পর্যন্ত এসে বাংলা আধুনিক গান নতুন দিকে মোড় নিল বলা যায়। কেননা, নজরুল থেকেই বাংলা গান দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। গানে গীতিকার একজন, সুরকার অন্যজন এবং গায়ক-গায়িকাও অন্য আরেকজন। এই তিনের সমন্বেয়ে আধুনিক বাংলা গান রচিত ও বিকশিত হলো।নজরুল সমকালীন এবং পরবর্তী গীতিকারগণ মূলত এই ধারাই অনুসরণ করেছেন তথাপি গজল গানকে প্রায়োগিক করে সার্থক রূপ দেন নজরুল। রঙ্গিন প্রেমের গজল নিয়ে আধুনিক বাংলা গানকে সুদ্ধ করেছেন নজরুল। সেই সঙ্গে স্মরণীয় সাকিশরাব, প্রেম, প্রকৃতি, চাঁদ, ফুল, মালা, নদী, পাখি, বিরহ-মিলন গাঁথা, পত্রলেখা, মানসি আর সমাধির অনুসরঙ্গ নজরুল তাঁর গানে প্রয়োগ করেন যা পরবর্তী গীতিকারগণ অনুসরণ করেছেন এবং এখনও তাঁরই অনুসরণ আমরা লক্ষ্য করি আধুনিক গানে।বর্তমান সংকলন গ্রন্থে এবষয় বিবেচনায় রেখে গানগুলো নির্বাচন করা হয়েছে। ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী ১ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
এক সম্ভ্রান্ত সংগীত পরিবারে ড. মৃদুলকান্তি চক্রবর্তীর জন্ম সুনামগঞ্জে ১৯৫৫ সালে। বাবা মনােরঞ্জন চক্রবর্তী ভালাে বাঁশি বাজাতেন, মা দীপালী চক্রবর্তী এস্রাজ ও সেতার বাজাতেন। শৈশব থেকেই সাংগীতিক পরিবেশে মৃদুলকান্তি বেড়ে ওঠেন। সংগীতে হাতেখড়ি হয়। বড় বােন রত্না ভট্টাচার্যের কাছে। পরে শান্তিনিকেতনে রাগসংগীত ও রবীন্দ্রসংগীতে শিক্ষা লাভ করেন— অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় (বিষ্ণুপুর ঘরানা), শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিল্পী নীলিমা সেন ও অধ্যাপক মােহন সিং খাঙ্গোরার কাছে। ১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের একজন নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হিসেবে সংগীত পরিবেশন করতে থাকেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৬ সালে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মনােনীত হয়ে বৃত্তি লাভ করে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনিকেতন থেকে যথাক্রমে বি. মিউজ ও এম. মিউজ কৃতিত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। পরে, সংগীত বিষয়ে পিএইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন এই বিশ্বভারতী থেকে ১৯৯৪ সালে। দীর্ঘদিন ধরে ড. মৃদুলকান্তি বাংলা সংগীতের নানা দিক নিয়ে গবেষণারত। দেশে-বিদেশে তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রশংসিত ও সমাদৃত সুধীজনের কাছে। জার্মানির Free University of Berlin-এ Prof. Josef Kuckertz-এর অধীনে গবেষণা করেন ‘Sources of Rabindranath Tagore Songs in Western Music' facil ১৯৮৩ সাল থেকে বাংলাদেশ বেতার ঢাকা এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে রবীন্দ্রসংগীত ও লােকসংগীত বিশেষত হাসন রাজার গান গেয়ে। আসছেন। সংগীত বিষয়ে তার অন্যতম অবদান হল লােক বাদ্যযন্ত্র ‘দোতারা’কে পরিমার্জন করে নতুন উদ্ভাবন করেছেন ‘সুরশ্রী’ বাদ্যযন্ত্র। টেলিভিশনে ‘সুরশ্রী’ বাজিয়েছেন এবং বিদেশেও এই যন্ত্রটি নিয়ে অনুষ্ঠান করেছেন। জার্মানির বার্লিন, লন্ডন ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে লেকচার ডেমনস্ট্রেশন ও সংগীত পরিবেশন করেছেন। সংগীত বিষয়ে শিক্ষকতা করেছেন ছায়ানট, বেণুকা, সংগীতভবন ও সুরের ধারায়। ড. মৃদুলকান্তি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিয়ােজিত এবং নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।