“তিন শতকের কলকাতা” বইয়ের ভূমিকা: তিন শো বছর আগে যেখানে বনে জঙ্গলে ঘেরা কয়েকটি ছোট ছোট গ্রাম ছিল কেমন করে সেখানে মহানগরী কলকাতা গড়ে উঠল—ইতিহাসে তার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। সাধারণত এই বর্ণনায় থাকে বড় বড় রাজনৈতিক ঘটনা-খ্যাতনামা লোকের ক্রিয়াকলাপ, শাসন-সংক্রান্ত বিবরণ প্রভৃতি। কিন্তু সাধারণ লোকের মন তাতে তৃপ্ত হয় না। প্রথম প্রথম এই নগরীর সামাজিক ও নৈতিক জীবনযাত্রা কেমন ছিল, এখনকার কলকাতায় আমরা যে সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধা ভোগ করি কেমন করে তা ধীরে ধীরে গড়ে উঠল, এই সকল বিষয় জানিবার জন্য অনেকেরই কৌতুহল হয়। এই কৌতুহল মেটাবার জন্যই এই বইখানি লেখা হয়েছে। গ্রন্থকার বহু আয়াসে নানারকম তথ্য সংগ্রহ করে পুরনো শহর কলকাতার একটি মনোরম চিত্র পরিবেশন করেছেন। এ বই পড়ে পাঠকেরা জানতে পারেন কেমন করে পরস্পরের ভাষা না জেনেও ইংরেজ বণিক বাঙালির সঙ্গে ব্যবসা করতে আরম্ভ করলেন এবং তার ফলে এদেশে এক নতুন ধনী সম্প্রদায়ের আবির্ভাব হল; নিজের দেশ থেকে বহু দূর এসে ইংরেজরা ধীরে ধীরে এ দেশীয় আচার ব্যবহারে অভ্যস্ত হলেন-তারা আলবোলায় তামাক খেতেন, পালকি চড়ে যাতায়াত করতেন, টানা পাখার হওয়ায় গরমের কষ্ট লাঘব করতেন; আমেরিকা থেকে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে বরফ আমদানি হওয়ায় গরমের কষ্ট আরো খানিকটা কমলো, বিলেতের মতো এদেশে কফি হাউস গড়ে উঠল ইত্যাদি। সাহেবদের নৈতিক জীবনের সম্বন্ধেও অনেক খবর এ বইয়ে আছে। পুরুষের তুলনায় তখন ইংরেজ মেয়েদের সংখ্যা খুব কম ছিল—সুতরাং বিলাতের কোনো জাহাজ খিদিরপুরে ঘাটে লাগলেই যে কটি মেমসাহেব নামতেন। তাদের বিয়ে করবার জন্যে অবিবাহিত ছেলেদের মধ্যে হুড়োহুড়ি লাগত; যে সকল ব্যর্থ প্রণয়ীর দল “না।” জবাব পেয়ে মনের দুঃখে ফিরে আসতেন তাদের বলা হত 'Juwabled' এবং তারা ‘Juwabled Club’-এর সদস্য হতেন এবং বিয়ে হয়ে গেলেই এই ক্লাব থেকে তাদের নাম কাটা যেত। এর ফলে ইংরেজ সমাজে যে ব্যভিচারের সৃষ্টি হয়েছিল লেখক সে সম্বন্ধেও ইঙ্গিত করেছেন—এবং দু-একটি কাহিনীও উল্লেখ করেছেন। ডুয়েল অর্থাৎ দুই প্রতিদ্বন্দীর মধ্যে বন্দুক বা তরবারি নিয়ে যুদ্ধ সে আমলের একটি বিশেষত্ব ছিল এবং গড়ের মাঠের দক্ষিণ প্রান্তে নির্জন স্থানে গাছের আড়ালে এই রকম প্রাণান্তক যুদ্ধ কারো কাছে আশ্চর্য মনে হত না। বাঙালি ধনী সম্প্রদায়ও নানা রকম বিলাস ব্যসনে মত্ত থাকতেন। সেকালে নর্তকীদের খুব প্রাধান্য ছিল এবং ‘হিঙ্গন’ ‘নিকী’ প্রভৃতি নাচনেওয়ালীরা কলকাতায় খুব প্রসিদ্ধ ছিল। দুর্গ পূজা ও বিবাহ প্রভৃতি উৎসবে ধনীদের বাড়িতে নাচের আয়োজন হত-বড় বড় সাহেবরা, এমন কি লাট ও লাটিপত্নীও তাতে যোগ দিতেন এবং পান-ভোজনেরও প্রচুর ব্যবস্থা ছিল। সে আমলের চুরি ডাকাতি এবং পুলিশের তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক কথা আছে। তখনকার মাছের বাজারের যে বিবরণ আছে তা অনেকেই উপভোগ করবেন। তখনকার দিনে ইংরেজি কাগজের সম্পাদকদের উপর সরকারী কর্মচারীরা কিরূপ অত্যাচার করতেন তারও দৃষ্টান্ত আছে। সরস বর্ণনার ফলে এই তথ্যবহুল গ্ৰন্থখানি গল্প ও উপন্যাসের মতো চিত্তাকর্ষক হয়েছে। যাঁরা কলকাতা সম্বন্ধে আরো বিশেষভাবে জানতে চান তাদের জন্যে বইয়ের শেষে কলকাতার প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধের বিস্তৃত তালিকা দেওয়া হয়েছে। এ বইখানিতে লেখকের পাণ্ডিত্য, অধ্যবসায়, পরিশ্রম ও সাহিত্যিক প্রতিভার যথেষ্ট পরিচয় আছে। আমি এর বহুল প্রচার আশা করি।
“তিন শতকের কলকাতা” বইয়ের সূচিপত্রঃ * দোভাষিরা * পালকি * আলবোলা * প্রথম হাসপাতাল * কলকাতায় মেমসাহেব * কলকাতায় ডুয়েলিং * কফি হাউস * জবাব ক্লাব * কলকাতার সংবাদপত্রের গোড়ার কথা * একজন সম্পাদকের নির্বাসন * পাখার হাওয়ার কালের ছন্দ * কলকাতায় আমেরিকার বরফ * মফঃস্বলে সাহেব * কোম্পানি আমলের ডাকাত * বেলভেডিয়ারে চুরি * সে যুগের আয়া * সে কালের নর্তকী * নর্তকী নিকী * হারানো আসর * সেকালের মাছের বাজার * ইতিহাসের দুর্ভাগিনী সারা টম্পসন * চিরকুমারী সভা * নির্বাচিত পাঠ্য তালিকা * (কলকাতার ইতিহাস – গবেষনা সহায়ক) * The Story Of Calcutta
“তিন শতকের কলকাতা” শেষ ফ্ল্যাপের কথা: তথা জোব চার্নকের সৃষ্টি, নাকি কলকাতা আগে " | বিতর্কের শেষ নেই। | কলকাতার কবে পত্তন তারিখ নিয়েও পণ্ডিতরা বহুমত। কিন্তু একথা ঠিক, ইংরেজদের প্রথম ঘাঁটি স্থাপন, ব্রিটিশ ভারতের প্রথম রাজধানী হওয়া, বাংলা তথা সমগ্ৰ ভারতের শিক্ষা-সংস্কৃতির রেনেসঁসের কেন্দ্ৰবিন্দু হওয়ার যে গৌরবময় ইতিহাস কলকাতা শহরের, তার অন্তত তিনশ বছর পূর্তি হতে চলেছে। এই বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। এই তিনশ বছরে কলকাতার অগ্ৰগতি প্রথমাগত ইংরেজদের কালে, কত কি অসুবিধা ছিল যানবাহনের এবং নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্যের, বাবু সমাজ ও ইংরেজদের আমোদ-প্রমোদের উপকরণ কি ছিল, থেকে ফরাসী-হুকা টানার ইতিহাস, আমেরিকা থেকে কলকাতায় বরফ আনা, ইংরেজ রাজপুরুষদের প্রণয় দ্বন্দু-এমন সব নানা চিত্র ও তথ্য লেখক নিখুঁত কলমে তুলে ধরেছেন একটি একটি করে। কে জানত এক সময় এখানকার প্রবাসী ইংরেজ তরুণদের মধ্যে পড়ত, তেমনিই একদিন পালটে যাবে অবস্থা! পুরুষদের থেকে নারীর সংখ্যা গেল বেশি হয়ে। শেষে অবিবাহিতা ইংরেজ রমণীরা পত্তন করলেন চিরকুমারী সভা। এমন বহু তথ্যদায়ক চিত্তাকর্ষক রচনায় ঋদ্ধ তিন শতকের কলকাতার এই পরিমার্জিত পরিবর্ধিত সংস্করণ।