”আশাপূর্ণা দেবী রচনাবলী ১১তম খণ্ড” বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা বাংলা সাহিত্যে মহিলা-ঔপন্যাসিকদের মধ্যে আশাপূর্ণা দেবীর লেখনী জনপ্রিয়তা ও গুণগত উৎকর্ষে একটি দীর্ঘস্থায়ী ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। যদিও তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার বিকাশ ব্যক্তি, পরিবার ও গার্হস্থ্যজীবনকে কেন্দ্র করে, কিন্তু তাঁর সাহিত্যকৃতি পন্ধবের মতাে সেইখানেই স্থিতিলাভ করেনি, বরং কূলভাঙা গতিতে ঘটনাপ্রবাহের দুই পার প্লাবিত করে বাঙালির বৃহত্তর সামাজিক পটভূমিকায় সে-প্রতিভা বিস্তার লাভ করেছে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিও ক্ষুরধার লেখনী বাঙালির সংসার-জীবনের উপরকার বর্ণাঢ্য মােহজাল ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে তার বাস্তবরূপ দেখিয়েছে। সাহিত্যসৃষ্টির প্রারম্ভেই তিনি বুঝেছিলেন যে সমাজকে বাদ দিয়ে সাহিত্যসৃষ্টি সম্ভব নয়, কারণ সাহিত্য সমাজেরই দর্পণ। অথচ সেই সামাজিক জীবন থেকে অনেক দূরে চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তাঁর পরিচিত জগৎ। কেবলমাত্র দৃষ্টি ও শ্রুতির সাহায্যে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন সেই জগৎকে। জানলার ফাঁক-ফোকর থেকে যতটুকু দেখা যায় শিল্পসৃষ্টির পক্ষে তাই যথেষ্ট- এই ছিল তার দৃঢ় প্রতীতি। যে সময়ে তাঁর সাহিত্যে আবির্ভাব তখন। পারিবারিক বিধিনিষেধের কঠিন জাঁতাকলে বাইরের জগতে প্রবেশের অধিকার ছিল না নারীজাতির। কিন্তু তাঁর লেখনীর যাদুস্পর্শে মনের আয়নায় তিনি ভিতর-বাইরের ব্যবধান ঘুচিয়েছেন অবলীলাক্রমে। পারিবারিক জীবন থেকে কলরবমুখর সামাজিক জীবনে উত্তরণ তার কোন কোন উপন্যাসের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। কল্প রােমান্সের নায়িকা এবং ঘরােয়া জীবনের ভারবাহী বাঙালি মেয়েদের দুটি মূর্তি তিনি বিচিত্র কৌশলে ফুটিয়ে তুলেছেন। বিভিন্ন উপন্যাসে, ছােটগল্পে ছড়িয়ে থাকা তারই ব্যাপক নিদর্শন পাঠকদের সামনে উপস্থাপিত করার জন্য এই রচনাবলী প্রকাশের আয়ােজন।
Ashapurna Debi (৮ই জানুয়ারি, ১৯০৯ – ১৩ই জুলাই, ১৯৯৫) বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার ও শিশুসাহিত্যিক। ১৯২৪ সালে, মাত্র ১৫বছর ৮ মাস বয়সে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা কালিদাস গুপ্তের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়। বিংশ শতাব্দীর বাঙালি জীবন, বিশেষত সাধারণ মেয়েদের জীবনযাপন ও মনস্তত্ত্বের চিত্রই ছিল তাঁর রচনার মূল উপজীব্য। ব্যক্তিজীবনে নিতান্তই এক আটপৌরে মা ও গৃহবধূ আশাপূর্ণা ছিলেন পাশ্চাত্য সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা। বাংলা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও ভাষায় তাঁর জ্ঞান ছিল না। বঞ্চিত হয়েছিলেন প্রথাগত শিক্ষালাভেও। কিন্তু গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণশক্তি তাঁকে দান করে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখিকার আসন। তাঁর প্রথম প্রতিশ্রুতি-সুবর্ণলতা-বকুলকথা উপন্যাসত্রয়ী বিশ শতকের বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলির অন্যতম বলে বিবেচিত হয়। তাঁর একাধিক কাহিনি অবলম্বনে রচিত হয়েছে জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। দেড় হাজার ছোটোগল্প ও আড়াইশো-র বেশি উপন্যাসের রচয়িতা আশাপূর্ণা সম্মানিত হয়েছিলেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার সহ দেশের একাধিক সাহিত্য পুরস্কার, অসামরিক নাগরিক সম্মান ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রিতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে প্রদান করেন পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সম্মান রবীন্দ্র পুরস্কার। ভারত সরকার তাঁকে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপে ভূষিত করেন। ১৯৯৫ সালে ১৩ জুলাই তিনি মৃত্যু বরণ করেন।