"কল্লোল গল্প সমগ্র -৩য় খণ্ড" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: কল্লোল পত্রিকার শুভ সূচনা লগ্নের নেপথ্যে রয়েছে ফোর আর্টস ক্লাব বা চতুষ্কলা সমিতির অবদান। গােকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, সুনীতি দেবী এবং সতীপ্রসাদ সেন ছিলেন ফোর আর্টস ক্লাবের চার সদস্য। জাতিধর্ম, স্ত্রী-পুরুষ, বালকবৃদ্ধ নির্বিশেষে সকলেই এই ক্লাবের সভ্য হতে পারত। সভার প্রথম অধিবেশন হয়েছিল ৮৮বি হাজরা রােডের ঠিকানায়। এই বাড়িটি ছিল, দীনেশরঞ্জন দাশের জামাইবাবু সুকুমার দাশগুপ্তের। ঠিক হয়, এই সভার মাসিক চাঁদা হবে এক টাকা। ফোর আর্টস ক্লাবের নাম দেন গােকুলচন্দ্র নাগ। সম্পাদক পদে বৃত হন দীনেশরঞ্জন দাশ। প্রতি বুধবার ক্লাবের সাধারণ সভা হবে এবং সভার দিন নানা বিষয় আলােচনা হবে। এই স্থির হয়েছিল। কোন জিনিসই স্থায়ী নয়। ফোর আর্টস ক্লাব দু বছর পর উঠে গেল। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ৪ জুন সভার প্রথম অধিবেশন বসেছিল। পরের বছর সভা বন্ধ হয়ে যায়। এই ক্লাব থেকে প্রকাশ পেয়েছিল একটি গল্প সংকলন নাম ‘ঝড়ের দোলা। ফোর আর্টস ক্লাবের মৃত্যু হল। কিন্তু এই ক্লাবের সত্তা থেকেই উঠে এল কল্লোল পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা। গােকুলচন্দ্র নাগের ব্যাগে ছিল এক টাকা আট আনা এবং দীনেশরঞ্জন দাশের সম্বল দুই টাকা মিলিয়ে কাগজ কিনে ছাপা হয়ে গেল ‘কল্লোল’-এর প্রথম হ্যান্ডবিল। ১৩৩০ বগাব্দের প্রথম দিবসে কল্লোল পত্রিকা প্রকাশ পেল। ‘কল্লোল’-এর সূচনায় দীনেশরঞ্জন দাশ কবিতা লিখছেন, “আশা আছে তবু যদি কোনদিন শতশত যুগ পরে বধির শিলার ফেটে যায় বুক গুঁড়াইয়া যায় তার নিজ সুখ, জলকল্লোল তুলি ভীমরােল বক্ষ তাহার ভরে।” প্রবল বিরুদ্ধ বাদ, বিহবল ভাববিলাস, অনিয়মাধীন উদ্দামতা, সর্বব্যাপী নিরর্থকতা, সংগ্রামের মহিমা, ব্যর্থতার মাধুরী অর্থাৎ যুগের যন্ত্রণাই প্রতিভাত হয়েছে ‘কল্লোল’-এ। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত ‘কল্লোল যুগ’-এ যথার্থই বলেছেন, “কল্লোল বললেই বুঝতে পারি সেটা কি। উদ্ধত যৌবনের ফেনিল উদ্দামতা, সমস্ত বাধাবন্ধনের বিরুদ্ধে নির্বারিত বিদ্রোহ, স্থবির সমাজের পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার আলােড়ন।” শৈলজানন্দ মুখােপাধ্যায় বলেছেন, “আজকের দিনে যত নতুন লেখক আছে স্তব্ধ হয়ে, সবায়ের ভাষাই ঐ কল্লোল। সৃষ্টির কল্লোল, স্বপ্নের কল্লোল, প্রাণের কল্লোল। বিধাতার আশীর্বাদে তাই সবাই একত্র হয়েছি। মিলেছি এক মানসতীর্থে। শুধু আমরা ক'জন নয়, আরাে অনেক তীর্থঙ্কর।” অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, “কল্লোলকে নিয়ে যে প্রবল প্রাণােচ্ছাস এসেছিল তা শুধু ভাবের দেউলে নয়, ভাষারও নাটমন্দিরে। অর্থাৎ ‘কল্লোলে’র বিরুদ্ধতা শুধু বিষয়ের ক্ষেত্রেই ছিল না, ছিল বর্ণনার ক্ষেত্রে। ভঙ্গি ও আঙ্গিকের চেহারায়। রীতি ও পদ্ধতির প্রকৃতিতে। ভাষাকে গতি ও দ্যুতি দেবার জন্যে ছিল শব্দসৃজনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। রচনাশৈলির বিচিত্রতা এমনকি বানানের সংস্করণ। যারা ক্ষুদ্র প্রাণ, মূঢ়মতি, তারাই শুধু মামুলি হবার পথ দেখে আরামরমণীয় পথ—যে পথে সহজ খ্যাতি বা কোমল সমর্থন মেলে, যেখানে সমালােচনার কাটাখোচা নেই, নেই বা নিন্দার অভিনন্দন। কিন্তু কল্লোলের পথ সহজের পথ নয়, স্বকীয়তার পথ।” রবীন্দ্রনাথ করেছেন সুন্দরের উপাসনা। শরৎচন্দ্র বাস্তবজীবনের নিখুঁত ছবি এঁকেছেন। আর কল্লোল সেই পথ থেকে একটু সরে ঝুঁকেছিলেন শিল্পকেন্দ্রিক নগরজীবন, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও শ্রমিকের জীবনের অন্ধকার অংশটুকু তুলে ধরতে। বঙ্গভঙ্গ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, পেশাগত টানাপােড়েন, জীবনের নিশ্চয়তাহীনতা, রাশিয়ায় শ্রমিকদের নেতৃত্বে সমাজবিপ্লবের নবাগত স্বপ্ন ফরাসি সাহিত্যিকদের নতুনভাবে ভাবিয়ে তােলে। কল্লোলের লেখকেরা এই নব্য সাহিত্যরীতিতে আকর্ষণ বােধ করেছিল। তার ফলশ্রুতি আমরা ‘কল্লোল’-এ পেয়ে গেলাম।
Arun Mukhapaddhay-এর জন্ম ১৯৬৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম.এ.। পারিবারিক ভদ্রাসন চন্দননগর। পেশা শিক্ষকতা। শখে বিশেষ কোনও বিষয় নিয়ে গবেষণা ও প্রয়োজনে ক্ষেত্র-সমীক্ষা। ইতিপূর্বে প্রকাশ পেয়েছে তাঁর অনুলিখনে খ্যাতনামা বাঙালি লেখকদের স্ত্রীর মুখের কথা আমার স্বামী।‘সেরা লেখিকাদের সেরা গল্প’, ‘একশ বছরের সেরা হাসি’ সম্পাদনাকর্মে যুক্ত থেকেছেন। পশ্চিমবঙ্গের শতবর্ষ অতিক্রান্ত গ্রন্থাগারগুলির ইতিবৃত্ত এই বাংলার শতায়ু গ্রন্থাগার’ নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর একক সম্পাদনায় প্রকাশ পেয়েছে ‘বাংলার সেরা প্রবন্ধ, রায়বাহাদুর প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় প্রণীত ‘দারোগার দপ্তর’(দুই খণ্ড), শৈলবালা ঘোষজায়ার ‘সেরা পাঁচটি উপন্যাস’। চারখণ্ড ‘কল্লোল গল্পসমগ্র’ সম্পাদনায় রেখেছেন নিষ্ঠার স্পর্শ। ‘হিন্দুতীর্থ গয়া’ তাঁর লেখা তীর্থভ্রমণ ও ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ।