শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যের জন্য যেমন প্রয়োজন বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী, তেমনি গরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কল্পনার সহযোগিতা। শ্রীযুক্ত গজেন্দ্রকুমার মিত্রের গল্প-উপন্যাসে এই দুই ধারার যথার্থ' মিলন হয়েছে, তা তাঁর রচনাবলীর এই খণ্ডে দুটি উপন্যাসের ( ‘রাত্রির তপস্যা’—১৯৪৮, ‘কলকাতার কাছেই – ১৯৫৭ ) কথাবস্তু আলোচনা করলেই বোঝা যাবে। একটিতে ('রাত্রির তপস্যা') বাস্তবের সঙ্গে কল্পনার মিশ্রণ ঘটেছে উপন্যাসের স্বাভাবিক রীতিতে। আর একটিতে ( ‘কলকাতার কাছেই' ) কল্পনাবর্জিত নিছক বাস্তবতা, তিক্ত জীবন- ধারণের গ্লানি ও নৈরাশ্য এবং বঞ্চনা প্রতিটি মহত কে দঃসহ করে তুলেছে । ‘রাত্রির তপস্যা’ গজেন্দ্রকুমারের সাহিত্যকৃতির প্রথম পর্বের সার্থক সৃষ্টি। ইতিপূর্বে— তাঁর অনেকগুলি গল্প ও উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে এবং তাতে তাঁর রচনারীতি ও মনঃপ্রকৃতি পূর্ণতা লাভ করেছে। ‘রাত্রির তপস্যা' এই পর্বে র সর্বাধিক পরিণত উপন্যাস । ভূপেন্দ্র আদর্শবাদী দরিদ্র ছাত্র, নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যৌবনে উপনীত হল এবং মফঃস্বলের শিক্ষকজীবনকে বৃত্তি বলে গ্রহণ করল, কিন্তু কাজে যোগ দিয়ে এবং শিক্ষকবৃত্তির অধঃপতন দেখে বিস্মিত ও বিষণ্ণ হল । দিনগত পাপক্ষয়ের বৃত্তিকে নীচতা ও প্রলোভনের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য সমস্ত বিরুদ্ধতার বিরদ্ধে তার নিঃসঙ্গ সংগ্রাম এই উপন্যাসের মূল কথা। কঠোর বাস্তব ঘটনা ও ক্লেদাক্ত নীচতার পাষাণপ্রাচীরে আহত হয়ে অনেকেরই শিক্ষক- বৃত্তির স্বপ্নের ফলগগুলি ফাটবার অবকাশ পায় না। কেউ আশাহীন আনন্দহীন বৃত্তি ত্যাগ করে অন্য জীবনে চলে যায়, কেউ বৃথা বাদ-প্রতিবাদের মধ্যে না গিয়ে সেই অপ্রীতিকর জীবনকেই আঁকড়ে ধরে কায়ক্লেশে বেঁচে থাকে। আবার মষ্টিমেয় দু-একজন শত্রু যে শিক্ষার উচ্চতম আদর্শ' আঁকড়ে থাকে তা নয়, দূষিত পরিবেশ ও ভ্রষ্টাচার থেকে শিক্ষকদের সেই আদর্শের ছত্রছায়ায় আনতে চেষ্টা করে। হয়তো তারা ব্যর্থ হয়, কিন্তু কখনো নৈরাশ্যের বলি হয় না । ভূপেন্দ্র মরচে-ধরা লৌহপিণ্ডবৎ শিক্ষকজীবনকে স্বর্ণ খণ্ডে রূপান্তরিত করতে চেষ্টা করেছিল। গজেন্দ্রকুমার এই উপন্যাসে এমনি একটি যুবকের স্বপ্নকে সার্থক করতে চেয়েছেন। প্রসঙ্গক্রমে এই উপন্যাসে তিনি শিক্ষা, শিক্ষকজীবন ও গ্রাম্য পরিবেশের যে নিঃশ্বাসরোধী ধূম্রজালের বাতাবরণ এঁকেছেন তার নিষ্প্রাণ, নিরৎসক ও প্রায়-নিঃস্পন্দ পরিবেশ ও চরিত্র আমাদের চেতনাকেও যেন অসাড় করে ফেলে। শিক্ষকজীবনের এই জ্বালা-যন্ত্রণা, হতাশা ও আদর্শ - হীনতার ধূমাঙ্কিত কালিমা ভূপেন্দ্র নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলেছে । প্রতিকলে গ্রাম্য পরিবেশ ও আদর্শ ভ্রষ্ট শিক্ষকদের সাহচর্যে থেকেও সে নতুন প্রভাতের স্বপ্ন দেখেছে। হয়তো দুটি-একটি ব্যক্তি, দু-একজন বালক শিক্ষার্থী তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসে শিক্ষার যথার্থ তাৎপর্য উপলব্ধি করেছে, দু-একটি মনে সে প্রদীপ জ্বালাতে সমর্থ হয়েছে। সেইট কুই তার প্রাপ্তি, তাতেই সে সার্থক । এই খণ্ডের অন্তর্গত ‘কলকাতার কাছেই' উপন্যাসে যে পরিবারের কাহিনী শহর, হয়েছে, তারপরেও সে ধারা আরো দুটি উপন্যাসে ( ‘উপকণ্ঠে’–১৯৬১, ‘পৌষ-ফাল্গুনের পালা' – ১৯৬৪ ) প্রবাহিত হয়েছে। একটি দরিদ্র পরিবারের তিনপুরুষের দুঃখ-বেদনা হতাশা-ব্যর্থতায় শ্রীহীন আখ্যান দীর্ঘ কালপরিবেশে চেনা অচেনা চরিত্রের ভিড়ের মধ্য দিয়ে যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
গজেন্দ্রকুমার মিত্র (জন্ম: ১১ নভেম্বর - মৃত্যু: ১৬ অক্টোবর ১৯৯৪) তার জন্ম ১১ই নভেম্বর কলকাতা শহরে। বাল্যশিক্ষা শুরু হয় কাশীর এংলো-বেঙ্গলী স্কুলে। কলকাতায় ফিরে এসে ঢাকুরিয়া অঞ্চলে গজেন্দ্রকুমার বসবাস শুরু করেন এবং বালিগঞ্জ জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। স্কুল জীবন অতিক্রম করে অতঃপর তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে বই এর ব্যবসায় যোগ দেন ও ১৯৪০ সাল পর্যন্ত্য বই বিক্রি করেছেন গজেন্দ্রকুমার। স্কুল শিক্ষা সমাপ্তির কিছু পরেই বন্ধু সুমথনাথের সঙ্গে মাসিক সাহিত্যিক পত্রিকা 'কথাসাহিত্য' শুরু করেন| ১৯৩৬ সালে তৈরি হয় মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনা সংস্থা। গজেন্দ্রকুমারের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'মনে ছিল আশা', গল্পগ্রন্থ 'স্ত্রিয়াশ্চরিত্রম' | ১৯৫৯ সালে তাঁর 'কলকাতার কাছেই' উপন্যাস আকাদেমি পুরুস্কারে সম্মানিত হয়| 'কলকাতার কাছেই', 'উপকন্ঠে', 'পৌষ-ফাগুনের পালা'-এই ট্রিলজিকে (ত্রয়ী উপন্যাস) আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস বলে গণ্য করা হয়| পৌষ-ফাগুনের পালা ১৯৬৪ সালে রবীন্দ্র পুরুস্কার পায়| গজেন্দ্রকুমারের লেখনীর বিচরনক্ষেত্র বিরাট ও ব্যাপক, সামাজিক উপন্যাস, পৌরানিক উপন্যাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস, ছোট গল্প.কিশোর সাহিত্য-সর্বত্র তাঁর অবাধ গত| সুদীর্ঘ ষাট বছরের অধিককাল ধরে তাঁর কয়েক হাজার ছোটগল্প ও পঞ্চাশটিরও বেশি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে| তিনি ছিলেন একজন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি লেখক, প্রকাশক ও অনুবাদক।