তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’ এবং ‘পঞ্চগ্ৰাম’ আসলে উপন্যাস দুখানি সুবৃহৎ একখানি উপন্যাসের দুটি অংশ। এক অংশের নাম ‘চণ্ডীমণ্ডপ’, অপর অংশের নাম ‘পঞ্চগ্রাম’। এই দুই অংশের সাধারণ নাম ‘গণদেবতা’। যদিও ‘চণ্ডীমণ্ডপ”-এর নামকরণ করা হয়েছে ‘গণদেবতা’ এবং সেই নামেই উপন্যাসখানি পরিচিত তথাপি ‘গণদেবতা’ অংশের নয়, সমগ্রের নাম। এই সমগ্রের মধ্যেই লেখকের পরিকল্পিত গণদেবতার যথার্থ রূপ উদ্ভাসিত। ‘চণ্ডীমণ্ডপ’ এবং ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে তারাশঙ্কর কালান্তরের এক নূতন দেবতাকে আবাহন করেছেন। এ দেবতা বিষ্ণুও নন; শিব নন; এ দেবতা গণদেবতা। পৌরাণিক গণদেবতা অর্থাৎ আদিত্য, বিশ্ব, বসু, তুষিত, আভাস্বর, অনিল, মহারাজিক, সাধ্য, রুদ্র,—এই নয়জন দেবতার সমষ্টিও নয়। তারাশঙ্করের গণদেবতায় পৌরাণিক দেবতা নেই, আছে অনিরুদ্ধ, পাতু, শ্ৰীহরি, দুর্গা, দেবু, পদ্ম। এরা দেবতা নয়, মানুষ। আত্মকেন্দ্ৰিক একক মানুষ নয়, গোষ্ঠীকেন্দ্ৰিক সামাজিক মানুষ। গোষ্ঠীজীবনের গণশক্তিতে যে-দেবতার রথের চাকা চলে তিনি গণদেবতা। চণ্ডীমণ্ডপ এই গণদেবতার বিগ্ৰহ। অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে ‘গণশক্তি’ এবং ‘জনগণ' কথাগুলির রাজনৈতিক ব্যঞ্জনা আছে। কিন্তু তারাশঙ্কর গণদেবতা বলতে যা বুঝেছেন তা সামাজিক institution। তার অতিরিক্ত কিছু নয়। চণ্ডীমণ্ডপের সমাজ-শাসনের অন্যায়-অবিচারের সমালোচনা তিনি করেননি, এমন কি চণ্ডীমণ্ডপের শাসনশক্তির উপর তেমন প্রচণ্ড রকম গুরুত্বও তিনি আরোপ করেননি। চণ্ডীমণ্ডপের শাসন যে অস্বীকার করেছে সেও চণ্ডীমণ্ডপের বহির্ভূত নয়। চণ্ডীমণ্ডপের গোষ্ঠীসমাজের বিরুদ্ধে ব্যক্তি-বিবেকের বিদ্রোহের ইঙ্গিতও তারাশঙ্কর দেননি। ‘গণদেবতা’য় তারাশঙ্কর দেখিয়েছেন, চণ্ডীমণ্ডপকে আশ্রয় করে ব্যষ্টিজীবন গোষ্ঠীজীবনে পরিণত হয়েছে। চণ্ডীমণ্ডপ-আশ্রিত গোষ্ঠী জীবন এবং গোষ্ঠীজীবনের বিলয়, উগ্র ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যের উদ্ভব, শহরকেন্দ্ৰিক নূতন সামাজিক institution এর আবির্ভাব, agricultural economy-র পরিবর্তে industrial economy-র প্রাধান্য-বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের বাঙালী জীবনের যুগান্তরের এই ইতিহাস ধরা পড়েছে তারাশঙ্করের গণদেবতা পরিকল্পনায়। সে বিচারে ‘গণদেবতা’ এবং ‘পঞ্চগ্ৰাম’ একালের বাঙালীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের ভাষ্য। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের মানুষের জীবন সোজাও নয়, বাঁকও নয়, ত্রিভুজাকৃতি। রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজ সে ত্রিভুজের তিনটি বাহু। তারাশঙ্করের অনেক চরিত্র ত্রিভুজাকারের। সেটি তার ইতিহাস-চেতনার লক্ষণ। এবং এই কারণে ইতিহাসের পদক্ষেপের চিহ্ন পড়ে তারাশঙ্করের ‘পঞ্চগ্ৰাম’ এপিক লক্ষণাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। বিষয়গৌরবে এই দুখানি উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্বীকার করেই বোধ হয় ‘গণদেবতা’কে এ যুগের মহার্ঘ্যতম সাহিত্য-পুরস্কারের জন্য নির্বাচন করা হয়েছিল। --তারাপদ মুখোপাধ্যায়
Title
গণদেবতা/পঞ্চগ্রাম (জ্ঞানপীঠ সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত)
তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ছিলেন। ১৮৯৮ সালের ২৪ জুলাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলায় তাঁর জন্ম। তাঁর শৈশব কাটে এই বীরভূম জেলারই লাভপুর গ্রামে। ধর্মপরায়ণ ও আদর্শনিষ্ঠ বাবা-মায়ের কাছে তিনিও একই সততা ও আদর্শের শিক্ষা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন। লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। তবে নানা কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম শেষ করতে পারেননি। ভারতীয় স্বাধীনতা বিপ্লবের সময় রাজনৈতিক কারণে কারাভোগ করতে হয় তাঁর। মুক্তি পাওয়ার পর সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন পুরোপুরি। তাঁর অনন্য প্রতিভায় জন্ম নিয়েছে একেকটি অসাধারণ পাঠকনন্দিত সাহিত্যকর্ম। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় রচনাবলী বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সমৃদ্ধ সম্পদ। তাঁর লেখা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণীর মানুষের জীবনকে এককভাবে উপস্থাপন করে না, ফুটিয়ে তোলে গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সব বৈশিষ্ট্যকে। সাহিত্য সৃষ্টি করতে তিনি বাদ রাখেননি কোনো শাখা। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হলো ‘চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২)’, ‘পাষাণপুরী (১৯৩৩)’, ’ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯)’, ’কালিন্দী (১৯৪০)’, ’কবি (১৯৪৪)’, ’হাসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১)’, ‘কালরাত্রি (১৯৭০)’ ইত্যাদি। তারাশঙ্করের উপন্যাস সমগ্র সংখ্যার হিসাবে প্রায় ৬৫টি। এর মধ্যে ‘কবি’ উপন্যাসটি তারাশঙ্করের কালজয়ী উপন্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামার মাঝে তিনি বিভিন্ন শিল্পগোষ্ঠী ও সাহিত্য সম্মেলন এর নেতৃত্ব দান ও সভাপতিত্ব করেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার নির্বাচিত সদস্য হিসেবে তিনি আট বছর দায়িত্ব পালন করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় কবিতা সমগ্র হল ‘ত্রিপত্র (১৯২৬)। এছাড়াও সাহিত্য রচনা করেছেন ছোটগল্প, নাটক, প্রহসন ও প্রবন্ধ আকারেও। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ছোটগল্প সংকলন হলো ‘ছলনাময়ী (১৯৩৭)’, ‘রসকলি (১৯৩৯)’, ‘হারানো সুর (১৯৪৫)’, ‘কালান্তর (১৯৫৬), ‘মিছিল (১৯৬৯)’, ‘উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)’ ইত্যাদি। তাঁর রচিত অনেক উপন্যাস পেয়েছে চলচ্চিত্র রূপ, এদের মাঝে আছে ‘কালিন্দী’, ‘দুই পুরুষ’, ‘জলসাঘর’, ‘অভিযান’। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় উপন্যাস সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ‘শরতস্মৃতি পুরস্কার (১৯৪৭)’, ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক (১৯৫৬)’, ‘রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৫৫)’, ‘পদ্মশ্রী (১৯৬২)’, ‘পদ্মভূষণ (১৯৬৮)’ ইত্যাদি পুরস্কার ও উপাধি লাভ করেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় এর বই সমূহ মানুষের হৃদয়ে চিরস্থায়ী স্থান করে নিয়েছে। পাঠকনন্দিত এই বাঙালি কথাসাহিত্যিক ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরলোকগমন করেন।