নবনীতার অভিজ্ঞতার বিস্তার ও মানবচরিত্র দর্শনের পুঁজি বিপুল। পারিবারিক ঐতিহ্যে প্রাপ্ত সাহিত্যিক উত্তরাধিকার ও স্বকীয় চর্চার গুণে গভীর অন্তদর্শন, শক্তি ও তাঁর ব্যবহারের ক্ষমতা নবনীতার আয়ত্তে। তাঁর প্রতিভা কাব্যময় অন্তরঙ্গ রম্যনিবন্ধে এবং যুক্তিবদ্ধ বির্তকের প্রবন্ধে একই নৈপুণ্যে প্রকাশ পায়। নানা বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে নবনীতা আজকের বাংলা সাহিত্যে এক ঈর্ষণীয় স্থানের অধিকারী। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে : কবিতা, পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রবন্ধ, কৌতুক রচনা, ছোটগল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, কাব্যনাটক, রম্যরচনায়, আবার গদ্য পদ্যের স্বচ্ছন্দ অনুবাদে, শিশুসাহিত্যে, ছড়ায়, রূপকথায়— সর্বত্রই তাঁর অদ্বিতীয় লেখনীর সাবলীল সঞ্চার বাংলা সাহিত্যে নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। একটি বুদ্ধিদীপ্ত বিদুষী মনের স্পর্শ, মরমী দরদী হৃদয়বত্তা, রচনার প্রসাদগুণ, সেই সঙ্গে শৈল্পিক নিরাসক্তি এবং সকৌতুক দৃষ্টিভঙ্গি—এতগুলি দুর্লভ গুণে সমৃদ্ধ নবনীতার সাহিত্য আজ এক উচ্চতর কোটিতে প্রবেশ করেছে। ‘নব-নীতা' গ্রন্থখানি এই প্রতিভাময়ী শিল্পীর বিস্ময়কর সৃষ্টিবৈচিত্র্যকে পাঠকের দৃষ্টির সামনে একত্রে মেলে ধরার একটি নান্দনিক প্রয়াস ।
নবনীতা দেবসেন দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে তাঁর বাবা- মা'র 'ভালবাসা'(এখনো সেখানেই বসবাস করেন) গৃহে জন্মগ্রহন করেন । পিতা নরেন্দ্র দেব ও মাতা রাধারানী দেবী সেযুগের বিশিষ্ট কবি দম্পতি। ছেলেবেলায় এক বিশেষ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া উনি হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, ফরাসী, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাগুলি পড়তে পারেন। গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস, লেডি ব্রেবোর্ণ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর , হার্ভার্ড, ইণ্ডিয়ানা (ব্লুমিংটন) ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। ১৯৭৫- ২০০২ তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও বেশ কিছুকাল বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তাকে তুলনামূলক সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট অথরিটি মানা হয়। যাদবপুরে তিনি কবি বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহধন্য ছাত্রী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি সাহিত্য একদেমি পুরস্কার পান তার আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনা 'নটী নবনীতা' গ্রন্থের জন্যে। এছাড়াও তিনি মহাদেবী বর্মা ও ভারতীয় ভাষা পরিষদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৫৯ এ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রথম প্রত্যয়' প্রকাশিত হয় ও প্রথম উপন্যাস 'আমি অনুপম' ১৯৭৬ এ। কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী, উপন্যাস মিলে তার প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৩৮। এখনো নিয়মত বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন। ১৯৬০ এ তিনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ (পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী) অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ও তাদের দুই কন্যা। জ্যেষ্ঠা অন্তরা সাংবাদিক ও সম্পাদক এবং কনিষ্ঠা নন্দনা অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী।