‘বঙ্গভঙ্গ’ বইয়ের ব্যাখ্যা বঙ্গভঙ্গ বইখানা উপন্যাস-ইহা ইতিহাস বা রাজনীতি নহে, বড় জোর রুচিভেদে ইহাকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বা রাজনৈতিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে। সুবিদিত স্বদেশী আন্দোলন ইহার পটভূমি। স্বদেশী আন্দোলন মতো তাৎপর্যপূর্ণ সর্বভারতীয় আন্দোলন এদেশে আর হয় নাই। সভ্যজগতের পক্ষে রেনেসাঁসের যে স্থান ভারতবর্ষের পক্ষে সেই স্থান স্বদেশী আন্দোলনের। বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দ ইহার ইন্ধন সংগ্ৰহ করিয়া গিয়াছিলেন, তাহাতে অগ্নিসঞ্চার করিলেন তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জন। সেই যজ্ঞাগ্নি সমুদ্ভূত দ্ৰৌপদীর ন্যায় এই দেশী আন্দোলন। দ্ৰৌপদী কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ও কুরুবংশ ধ্বংসের মূল কারণ; স্বদেশী আন্দোলন মূল কারণ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংসের। বঙ্গভঙ্গের প্রতিক্রিয়ায় বয়কট। বয়কট দুটি ধারায় আত্মপ্রকাশ করিল—স্বদেশাত্মাকে আবিষ্কার এবং বোমা-পিস্তলবাহী অগ্নিযুগ। এই আন্দোলনের মধ্যেই বীজাকারে পরবর্তী সমস্ত আন্দোলন ছিল মায় গান্ধীবিপ্লব। সেই পটভূমির উপরে অঙ্কিত বঙ্গভঙ্গ উপন্যাস। কাজেই ইহার মধ্যে তৎকালীন ইতিহাস ও রাজনীতির ছায়াপাত হইয়াছে—তবু তাহা ছায়ামাত্র। উপন্যাসের কায়া অখণ্ড বঙ্গের কোন জেলার একটি সদর শহর। তাই বইখানাকে উপন্যাস বলিয়া গ্ৰহণ করিলে ইহার উপরে সুবিচার করা হইবে। দিনাজশাহী শহরের গোটা দুই তিন পরিবার ইহার অস্থি-মজ্জা, সেই পরিবারের লোকজন ইহার পাত্র-পাত্রী। ইহাতে দুই শ্রেণির নরনারী আছে—এক শ্রেণিতে স্বনামখ্যাত কয়েকজন ব্যক্তি যথা সুরেন বাঁড়ুজ্জে, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি। আর এক শ্রেণিতে পূর্বোক্ত পরিবার সমূহের নরনারী। শেষোক্ত শ্রেণির সকলেই কাল্পনিক। দিনাজশাহী নামে কোন শহর নাই—ইহা দিনাজপুর ও রাজশাহীর মিলনে “মোরগোরু” রূপ। এই নামটি প্রথমে ব্যবহৃত হইয়াছে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কোন বিখ্যাত গল্পে। আর কোন রায় বাহাদুর কর্তৃক মহারানী ভিক্টোরিয়ার শ্ৰাদ্ধানুষ্ঠান ব্যাপারটিও একটি সত্য ঘটনা। এই উপলক্ষে মহারানীর বিয়োগে একটি কবিতা লিখিত হইয়া পুস্তকাকারে প্রকাশিত হইয়াছিল। বাল্যকালে সেই পুস্তক দেখিবার সুযোগ হইয়াছিল। আমার, তাহার প্রথম কয়েক ছত্র এই গ্রন্থে উদ্ধৃত হইয়াছে। এই ব্যাখ্যা শেষে আর একবার মনে করাইয়া দিই—বঙ্গভঙ্গ বইখানা উপন্যাস-রাজনীতি ও ইতিহাসের ঘন ছায়াপাত সত্ত্বেও ইহা রাজনীতি বা ইতিহাস নয়—ইহা উপন্যাস।
পাশ্চাত্য জগতের পক্ষে রেনেসঁসের যে স্থান, ভারতবর্ষের পক্ষে সেই স্থান স্বদেশী আন্দোলনের। বঙ্কিমচন্দ্র ও বিবেকানন্দ এর ইন্ধন সংগ্ৰহ করেছিলেন, তাতে অগ্নিসঞ্চার করলেন লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ ঘোষণা করে। সেই যজ্ঞাগ্নি সমুদ্ভূত দ্রৌপদীর মতোই স্বদেশী আন্দোলন শুরু হল বঙ্গভঙ্গর আদেশকে উপলক্ষ করে। দ্ৰৌপদী কুরুক্ষেত্ৰ-যুদ্ধ ও কুরুবংশ ধ্বংসের মূল কারণ। স্বদেশী আন্দোলন মূল কারণ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ধ্বংসের। ...এই আন্দোলনের মধ্যেই বীজাকারে পরবর্তী সমস্ত আন্দোলন ছিল মায় গান্ধী-বিপ্লব। সেই পটভূমির উপরেই রচিত এই “বঙ্গভঙ্গ” উপন্যাস।
প্রমথনাথ বিশী ( Pramathanath Bishi, ১১ জুন ১৯০১ - ১০ মে ১৯৮৫) একজন লেখক, শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক। তিনি ১৯৬২-৬৮ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই জুন নাটোর জেলার জোয়াড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জমিদার পরিবারে জন্ম। পিতা নলিনীনাথ বিশী ও মাতা সরোজবাসিনী দেবী, স্ত্রী সুরুচি দেবী। ১৯১০ সালে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সেখানে এক নাগাড়ে সতের বছর অধ্যয়ন। মেধা, প্রখর বুদ্ধি, অধ্যয়ননিষ্ঠা, কবি-প্রতিভা ইত্যাদি গুণাবলির জন্য রবীন্দ্রনাথের স্নেহ লাভ। তিনি কেরী সাহেবের মুন্সী বইটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১০মে, ১৯৮৫ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।এছাড়াও প্রমথনাথ বিশী আনন্দ পুরষ্কার এ ভূষিত হয়েছেন ।