প্রমথনাথের বিস্ময়কর উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃষ্টিপ্রাচুর্য নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে যে লেখক কোন অজ্ঞাত অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে প্রাণশক্তির গোপন উৎসটির সন্ধান পাইয়াছেন ও অবলীলাক্রমে যদৃচ্ছকল্পিত নরনারীর মাধ্যমে এই প্রাণচেতনাকে রূপ দিতে পারেন। ব্যঙ্গাতিরঞ্জন ও সৃষ্টির অজস্রতা—উভয় দিক দিয়াই তিনি সমধর্মী লেখক। মননের দিক দিয়াও তাঁহার কৃতিত্বের পরিচয় নিঃসন্দিগ্ধ। যে প্রচুরসংখ্যক স্বল্পাক্ষর গভীরার্থক উক্তির সাহায্যে তিনি তাঁহার জীবন-পরিচয় ও মনস্তত্ত্বসমীক্ষা উদ্ঘাটিত করিয়াছেন তাহা পাষাণ-ফলকে উৎকীর্ণ লিপির -ন্যায় আমাদের মনে গভীর রেখাঙ্কিত হইয়া থাকে। যেমন তাঁহার সৌন্দর্য- চিত্রণে, তেমনি মনন-সন্নিবেশেও প্রতিবেশ ও উপলক্ষ্যের সহিত শিথিল-সংলগ্নতা ইহাদিগকে কতকটা আকস্মিকতার চমক-মন্ডিত করিয়া তোলে। কিন্তু লেখকের সর্বাধিক কৃতিত্ব হইতেছে একশত বৎসর পূর্বে ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে জনসাধারণের দরবারী ও মজলিসী আমেজযুক্ত জীবন-চিত্রাঙ্কনে। নবাব ও বাদশাহী আদব-কায়দা প্রভাবিত জীবনাদর্শ ঐ সমস্ত অঞ্চলের সমাজ-মানসে একটা বদ্ধমূল সংস্কাররূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সাধারণ লোকের আড্ডায়, সামাজিক মিলনের নানা উপলক্ষ্যে অভিজাত মহলের সৌজন্য-শিষ্টাচার, কাব্য ও সঙ্গীতপ্রীতি, উর্দু গজলের প্রণয়াতিশয্যমূলক ভাবালঙ্কারের মুহুর্মুহু উদ্ধার (quotation), সংলাপে হিন্দি ও উর্দু-মিশ্রিত বাচনভঙ্গীর অভ্যস্ত নিপুণ প্রয়োগ, এক প্রকারের আদর্শ-বিমুখ ও আরাম- শিথিল মেজাজের অনুশীলন – এ সমস্তই মধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রেণীর জীবন-চর্চায় চমৎকার ভাবে প্রতিফলিত হইয়াছে। লেখক তাঁহার সর্বশ্রেণীর চরিত্রের আচরণের মধ্যে এই বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহৃত করিয়াছেন। এই লোকজীবনের সঙ্গে তাঁহার যে ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে, উহার ছন্দটি তিনি যে একপ্রকার সহজ সংস্কারবশে অভ্রান্তভাবে ধরিতে পারিয়াছেন, তাঁহার মনের পরিপূর্ণ, চেষ্টাহীন সঞ্চয় হইতেই যে তাঁহার সৃষ্টিপ্রেরণা স্বতঃউদ্ভূত, তাহা সহজেই বোঝা যায়। সুতরাং ইতিহাসের সহিত সাধারণ জীবনের যোগ যতই শিথিল থাকুক না কেন, এক শতাব্দী পূর্বেকার এক বিশিষ্ট সংস্কৃতি কেন্দ্রের সন্নিহিত নগর ও জনপদ-জীবনের যে রীতিনীতি, আচার-আচরণ ও সমাজ-জীবনবদ্ধ ব্যক্তির যে সামাজিকতার প্রেরণা তিনি বর্ণনা করিয়াছেন তাহা কল্পনার পুনর্গঠন শক্তির, অতীতকে পুনর্জীবিত করিবার এক আশ্চর্য নৈপুণ্যের পরিচয় বহন করে।
প্রমথনাথ বিশী ( Pramathanath Bishi, ১১ জুন ১৯০১ - ১০ মে ১৯৮৫) একজন লেখক, শিক্ষাবিদ ও অধ্যাপক। তিনি ১৯৬২-৬৮ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন এবং ১৯৭২ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন। ১৯০১ খ্রীষ্টাব্দের ১১ই জুন নাটোর জেলার জোয়াড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জমিদার পরিবারে জন্ম। পিতা নলিনীনাথ বিশী ও মাতা সরোজবাসিনী দেবী, স্ত্রী সুরুচি দেবী। ১৯১০ সালে শান্তিনিকেতনের ব্রহ্মবিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সেখানে এক নাগাড়ে সতের বছর অধ্যয়ন। মেধা, প্রখর বুদ্ধি, অধ্যয়ননিষ্ঠা, কবি-প্রতিভা ইত্যাদি গুণাবলির জন্য রবীন্দ্রনাথের স্নেহ লাভ। তিনি কেরী সাহেবের মুন্সী বইটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ১০মে, ১৯৮৫ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।এছাড়াও প্রমথনাথ বিশী আনন্দ পুরষ্কার এ ভূষিত হয়েছেন ।