বিষয়বস্তুর নিবিড় মৌলিকতায়, মনুষ্যচরিত্রের জটিল স্বরূপ উন্মোচনে, ব্যক্তির সাধ ও সাধ্যের উপরে ঘটনাচক্রের প্রবল পরাক্রম নির্ধারণে, সামাজিক বাস্তবতার অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রান্তে অপ্রত্যাশিত আলোক প্রক্ষেপণে এবং তার সঙ্গে ভাবাবেগ বর্জিত রচনাভঙ্গির সূক্ষ্ম কলাকুশলতায় ও সমৃদ্ধ ভাষার গভীর ব্যঞ্জনায় প্রেমেন্দ্র মিত্রই বোধকরি আধুনিক বাংলা ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। ছোটগল্পে যাঁকে অনেক সময় অদৃষ্টবাদী মনে হয় তিনিই আবার কবিতায় একাধারে আদর্শবাদী ও মানবিকবাদী এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রর এই সদর্থকবাদী কবিসত্তারই অমোঘ প্রকাশ ঘটেছে 'মৃত্যুত্তীর্ণ' কবিতাটিতে। প্রভঞ্জনের বিবাগী মনের দোলা আর হতভাগাদের ভাঙা বন্দরের ব্যথা আর মানুষের মানে খোঁজার হয়রানি আর আফ্রিকার সিংহ-হিংস্র-মৃত্যুর উত্তেজনা আর মৃত কোনও মহাদেশে আর-এক লুপ্তিপণ খেলার আয়োজনে বাংলা কাব্যে সম্পূর্ণ নতুন এক রোমাঞ্চ সৃষ্টি করে এবং সেই সঙ্গে আধুনিক প্রসঙ্গের উপযুক্ত গদ্যছন্দ বাংলায় প্রথম প্রচলন করে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম কবি রূপে। 'পাক'-এ বিংশ শতাব্দীর নাগরিক বৃত্তিজীবী সমাজের বৃত্তান্তের পরে 'মিছিল'-এ গ্রাম-ভাঙা জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ মধ্যবিত্ত বাঙালির পরিচয় জিজ্ঞাসু ও ‘কুয়াশায় বিপর্যস্ত অস্তিত্বের বিচিত্র বিন্যাসের রূপকার রূপে আর স্বাধীনতা লাভের আগে-পরে জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিসত্তার দ্বিধাদ্বন্দ্বকে 'প্রতিধ্বনি ফেরে'তে নানা চরিত্রের দর্পণে অবলোকনকারী প্রেমেন্দ্র মিত্র একজন অনন্য উপন্যাসিকও, কিন্তু মেনে নেওয়া ভালো যে অবস্থাগতিকে সে-অনন্যতা ছোটগল্পের শিল্পী আর কবি হিসেবে উজ্জ্বল প্রসিদ্ধির আড়ালে কিছুটা নিষ্প্রভ। প্রেমেন্দ্র মিত্রই বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের জনক। সাহিত্যের এই নবীন বিভাগে তাঁর 'মনুদ্বাদশ' যেমন কল্পনার সঘন সংহতিতে সম্পূর্ণ বিশ্বাস্য তেমনই বিষয়ের বৈচিত্র্যে কৌতূহলোদ্দীপক, কিন্তু শুধু এ-ই নয়, বিবেকী বিবেচনাতেও 'মনুদ্বাদশ' এক মহৎ সৃষ্টি যা চিত্তাক্ষম বুদ্ধিজীবী সমাজের বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে। আবার ছোটদের সাহিত্যেও প্রেমেন্দ্র মিত্রর দান প্রভূত ঐশ্বর্যময় এবং বৈচিত্র্যময়। তাঁর অন্য সব রচনা বাদ দিলেও শুধু ছোটদের সাহিত্যে তাঁর বিপুল বর্ণাঢ্য সৃষ্টিশীলতা ও তার সঙ্গে প্রথর বিজ্ঞানমনস্কতা, তাকে নিঃসন্দেহে অবিস্মরণীয় করে রাখবে। মধ্যযৌবন পর্যন্ত তিনি বহু রকম চাকরি করেন। তার পর জীবিকার লড়াই আর শিল্পের 'সাধনা মিশে যায় চলচ্চিত্রের গীতিকার, কাহিনীকার ও পরিচালকের জীবনে। আবার ১৯৫৫ সালে আকাশবাণীর চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু ১৯৬২ থেকে সাহিত্যই তাঁর একাধারে জীবিকার লড়াই ও জীবনের সাধনা।
প্রেমেন্দ্র মিত্র ( জন্ম: ১৯০৪ - মৃত্যু: ৩ মে, ১৯৮৮) একজন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বাঙালি কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং চিত্রপরিচালক। বাংলা সাহিত্যে তাঁর সৃষ্ট জনপ্রিয় চরিত্রগুলি হল ঘনাদা, পরাশর বর্মা, মেজকর্তা এবং মামাবাবু।