মল্লিকদের বাড়ির তারাপদর কথায় সেই ছোটবেলা থেকেই কলকাতার নাম শুনে যেন রোমাঞ্চ হত ভূতনাথের। একদিন মিত্তিরদের টিপ্-চালতে গাছটার মগডালে গিয়ে উঠেছিল ভূতনাথ। এর হাজার-ডবল উঁচু। সে যে কতখানি—তা অনুমান করা শক্ত। তবু অনেক—অনেক দূরে চেয়ে চেয়ে দেখেছে সে। সোজা পশ্চিমদিকে চাইলে শুধু দেখা যায় কেবল গাছ আর গাছ। গাছের ফাঁকে ফাঁকে মাঠ। তারপর আকাশ। শুধু আকাশ আর আকাশ। আকাশময় চারিদিক। সন্ধেবেলা বাদুড়গুলো ওদিক থেকে ফল-পাকড় খেতে একটার পর একটা উড়ে আসে। ওই শহরের দিক থেকে। মাজদে' স্টেশনের চেয়েও অনেক দূরে—কত শহর—ফতেপুরের মত কত গ্রাম পেরিয়ে তবে কলকাতা। সেখানে ঘোড়ার ট্রামগাড়ি চলে খুব জোরে—সামনে আসতে দেখলে বুক দুর দুর করে। (কেন করে তা বলা যায় না) মিত্তিরদের টিপ্-চালতে গাছের হাজার ডবল উঁচু সব বাড়ি। তার মাথায় লোকগুলো দেখায় এতটুকু কড়ে আঙুলের মত। এমনি ভাবতে ভাবতে গাছ থেকে একসময় নেমে পড়ে ভূতনাথ। এর পর আর একদিনের ঘটনা। তখন অনেক বড় হয়েছে ভূতনাথ। ইস্কুলে এসে ভর্তি হল গঞ্জের হাসপাতালের বড় ডাক্তারের ছেলে ননী। ভারি ফুটফুটে ছেলেটা। যেমন ফরসা, তেমনি কালো কালো চোখ, বড় বড় চুল। পরে অনেকবার ভূতনাথ ভেবেছে ননী যেন ছেলে নয়। অনেক ভাব হবার পরেও ননীর হাতে আচমকা হাত ঠেকে গেলে কেমন যেন শিউরে উঠত ভূতনাথ। ইস্কুল থেকে মাইলের পর মাইল হেঁটে হেঁটে বাড়ি আসার পথে ননীর কথাই সারা রাস্তাটা ভাবত। এক-এক সময় মনে হত, ননী তার বোন হলে যেন বেশ হত। তাহলে দু'জনে এক বাড়িতে থাকত, শুতো এক বিছানায়। অনেক ছুটির দিন ভূতনাথ হেঁটে হেঁটে একা চলে গিয়েছে ইস্কুলের কাছে। তারপর লুকিয়ে লুকিয়ে হাসপাতালের আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েছে। ননীকে যদি একবার এক ফাঁকে দেখতে পাওয়া যায় ! আবার লজ্জাও হত। যদি ননী তাকে সত্যি সত্যিই দেখে ফেলে! যদি ননী জিজ্ঞেস করে –কি রে ভূতনাথ, তুই এখানে কেন—তখন কি জবাব দেবে সে?
Bimal Mitra কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের জন্ম ১৯১২ সালের ১৮ই মার্চ। চেতনা স্কুল ও আশুতোষ কলেজে শিক্ষালাভের পর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ পাশ করেন ১৯৩৮ সালে । গোড়ায় গান লেখার শখ ছিল । বিখ্যাত গায়করা তাঁর গানে সুর দিয়েছিলেন। পরে তিনি কথাসাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম জীবনে রেল বিভাগে চাকরি করতেন। তারপর সে গল্প-উপন্যাস প্ৰবন্ধ নিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা একশতরও অধিক। বাংলা ১৩৭০ সালে তার সরকার রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কারে সংবর্ধিত করেন। এই উপন্যাসটি এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম এবং সর্বোচ্চ মূল্যবান উপন্যাস। তবে সাহিত্য পুরস্কার লাভের থেকেও বিমল মিত্র সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বঙ্গভাষার সাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্রের পর তিনিই সর্বভারতীয় সাহিত্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিলেন । তিনি বেগম মেরী বিশ্বাস, সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম, একক দশক শতক, পতি পরম গুরু, এই নরদেহ-এপিক উপন্যাসের মাধ্যমে তিনশো বছরের সমাজজীবনের এক বিস্তৃতকালের চালচিত্র বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন । ১৯৯১ সালের ২রা ডিসেম্বর তার তিরোধান হয় ।