“কড়ি দিয়ে কিনলাম - ২য় (রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত)" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ একটি মহান উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম গ্রন্থ হিসাবে দুই খণ্ড কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বিশেষ সুপরিচিত। অতীতের মহাকাব্যের স্থান গ্রহণ করেছে বর্তমান কালের উপন্যাস। কড়ি দিয়ে কিনলাম’ তেমনি আধুনিক যুগ ও জীবনের এক মহাকাব্য-বিশেষ। কাহিনীর কালপরিধি অতিবিস্তৃত নয়, মাত্র একটি বালকের কৈশাের থেকে যৌবনের মধ্যভাগ পর্যন্ত। কিন্তু সেই স্বল্পকালের গণ্ডিতেই বাংলা দেশের বিপুলতম পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণ। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, নবজাগ্রত তরুণ সমাজ, আত্মবিস্মৃত তীব্র আদর্শবােধ, গভীর সত্যপরায়ণতা। কিন্তু মাত্র কয়েকটি বৎসরের অবলেপ দেশের চারিত্রিক দার্চকে নিঃশেষে মুছে নিয়েছে। সংসার ও আদর্শের দ্বন্দ্বে জর্জর মাস্টারমশাইয়ের দল তখন নেপথ্য ভূমিকা নিয়েছেন। নতুন ব্যবস্থায় স্বাধীনতার চরম অপব্যবহার ঘনিয়ে উঠেছে মিঃ ঘােষাল, হােসেনভাই, ছিটে-ফেঁাটার ক্ষমতালিপ্সায়। রাষ্ট্রনৈতিক আর সামাজিক ঘূর্ণাবর্তের মধ্যবিন্দু নায়ক দীপঙ্কর। তার ব্যক্তিজীবনে—একদিকে জাতীয় দুর্যোগ, অন্যদিকে যুগ-যন্ত্রণার প্রতিনিধি সতী-লক্ষ্মীদির দল। দীপঙ্কর কেবল কাহিনীর মধ্যবিন্দুই নয়, তার দৃষ্টিতেই সমগ্ৰ কাহিনীর রসভাষ্য। তার চরিত্রে action বা কোনরূপ কর্মভূমিকার আত্যন্তিক অভাব কারও কারও চোখে পড়তে পারে। সে এখানে নিষ্ক্রিয় দর্শকমাত্র, ক্যামেরার চোখের মত কাহিনীর সূত্রগুলি যান্ত্রিক নিপুণতার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করে গেছে। কিন্তু তার নিজস্ব কোন ব্যক্তিত্ব প্রকাশ পায়নি। তবে সেক্ষেত্রে একথা মনে রাখা প্রয়ােজন যে, পারিপার্শ্বিক সক্রিয়ভাবে ফুটিয়ে তােলার জন্যে হয়তাে এইরকম একরঙা প্রেক্ষাপটের প্রয়ােজন ছিল। ক্যানভাস সাদা না হলে বহুবর্ণের চিত্র ফোটানাে সম্ভব হয় না। কড়ি দিয়ে কিনলাম’ অনেকাংশে এপিকধর্মী এ কথা আগেই বলা হয়েছে। এপিক বা হাকাব্যে ব্যক্তিজীবন বা গহজীবন মখ্য নয়, সেখানে বিশাল এক দেশ-কালের চিত্র ফুটে sঠ। মােটা তুলির টানে এক বিশাল যুগকে প্রাণবন্ত করে তুলতে হয়। সেদিক থেকে আলােচ্য গৃহনি সার্থক। চরিত্র এখানে কাহিনী-ভাগের তুলনায় নিতান্ত স্বল্প। তবে পারিপার্শ্বিক ও যুগ পরিবেশ রচনে কাহিনীকার আশ্চর্য সাফল্যলাভ করেছেন। এখানে দেশ কাল এবং সমাজ ও পাত্রপাত্রী, তারাও প্রাণবন্ত। স্থির-লক্ষ্য এক জাতির আদর্শভ্রষ্টতা আর তার স্বাভাবিক পরিণাম—নিপুণ সহৃদয়তার সঙ্গে লক্ষ্য করা হয়েছে। অবশেষে এক আশাবাদী পরিণামচিন্তার মধ্যে কাহিনীর সমাপ্তি।
Bimal Mitra কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের জন্ম ১৯১২ সালের ১৮ই মার্চ। চেতনা স্কুল ও আশুতোষ কলেজে শিক্ষালাভের পর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ পাশ করেন ১৯৩৮ সালে । গোড়ায় গান লেখার শখ ছিল । বিখ্যাত গায়করা তাঁর গানে সুর দিয়েছিলেন। পরে তিনি কথাসাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম জীবনে রেল বিভাগে চাকরি করতেন। তারপর সে গল্প-উপন্যাস প্ৰবন্ধ নিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা একশতরও অধিক। বাংলা ১৩৭০ সালে তার সরকার রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কারে সংবর্ধিত করেন। এই উপন্যাসটি এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম এবং সর্বোচ্চ মূল্যবান উপন্যাস। তবে সাহিত্য পুরস্কার লাভের থেকেও বিমল মিত্র সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বঙ্গভাষার সাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্রের পর তিনিই সর্বভারতীয় সাহিত্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিলেন । তিনি বেগম মেরী বিশ্বাস, সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম, একক দশক শতক, পতি পরম গুরু, এই নরদেহ-এপিক উপন্যাসের মাধ্যমে তিনশো বছরের সমাজজীবনের এক বিস্তৃতকালের চালচিত্র বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন । ১৯৯১ সালের ২রা ডিসেম্বর তার তিরোধান হয় ।