"অব্যক্ত" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ‘অব্যক্ত’ বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্রের সমগ্র বাংলা রচনার একমাত্র সংকলন। সাহিত্য অপেক্ষা বিজ্ঞান চর্চায় জগদীশচন্দ্রের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়েছিল— তাই সঙ্গত কারণেই সাহিত্য রচনার অবকাশ তিনি অতি অল্পই পেয়েছিলেন। ফলে মাতৃভাষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ এবং বাংলাভাষায় নিজ বক্তব্যকে প্রকাশ করার অসামান্য দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও মাতৃভাষায় রচিত তাঁর লেখাগুলাে এই ছােট্ট সংকলনটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ক’টি রচনায়, বিশেষ করে তার বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলােতে তিনি যে-সাহিত্যপ্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তা অনন্যসাধারণ। এসব রচনায় বিজ্ঞানের গাম্ভীর্যই শুধু অনুপস্থিত তাই নয়, এগুলােতে এমনই কাব্যরসের মাধুর্য ও সুষমার সংমিশ্রণ ঘটেছে যে তা উচ্চাঙ্গের সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে উঠেছে। বিশ্বাস করা কঠিন যে এগুলাে জগদীশচন্দ্রের মতাে বিজ্ঞানীর রচনা। কেন এ অবিশ্বাস সে-কথায় পরে আসব। তার আগে এই ভূমিকায় খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও— এই বিশিষ্ট বাঙালি বিজ্ঞানী ও তাঁর বিস্ময়কর আবিষ্কার সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু তথ্য ও ঘটনার কথা বিশেষভাবে বলার প্রয়ােজন বােধ করছি। প্রধানত দুটি কারণে এই প্রয়ােজন। প্রথমত বাঙালিদের মধ্যে জগদীশচন্দ্রই বিজ্ঞানী হিসেবে শ্রেষ্ঠ; একই সঙ্গে তিনি একজন বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী। বাঙালি হিসেবে তাই তাঁকে নিয়ে আমাদের যথেষ্ট গর্ব বােধের কারণ আছে। কিন্তু কেন তিনি এমন বিশিষ্ট ও বিশ্বখ্যাত তার আবিষ্কারগুলােই-বা কী— সেগুলাে সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যেমন সীমিত তেমনি অস্পষ্ট। এমনকি যে অভূতপূর্ব আবিষ্কারের জন্য তিনি অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারক হিসেবে বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্মরণীয়— সে সম্পর্কেও আমাদের মধ্যে অনেকেই এখনও ভুল ধারণা পােষণ করে থাকেন। এই ভুল অপসারণের প্রয়ােজনে প্রথমেই সে সম্পর্কে একটু আলােচনা করে নিতে চাই। তাঁর বিশিষ্ট আবিষ্কারের প্রশ্নে যে জবাবদুটি অনেকের কাছ থেকেই আসে সেগুলাে হল : ১. জগদীশচন্দ্র গাছের প্রাণ আবিষ্কার করেছিলেন এবং ২. মার্কনির আগেই তিনি রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথম উত্তরটি একেবারেই ভুল; দ্বিতীয়টিও যে-অর্থে বলা হয়, সেই অর্থে সঠিক নয়। প্রথমটি সম্পর্কে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে, গাছের প্রাণ সম্পর্কে অনেক প্রাচীনকাল থেকেই পণ্ডিতেরা সম্পূর্ণ নিঃসংশয়। জগদীশচন্দ্রের পক্ষে তাই নতুন করে এটি আবিষ্কারের কোনাে প্রয়ােজন পড়ার কথা নয়। আবার এটিই যদি তাঁর আবিষ্কার হত তবে তাঁর আবিষ্কার নিয়ে তখনকার দিনে সারাবিশ্বে এতটা সাড়া বা আলােড়নের সৃষ্টি হত না। জগদীশচন্দ্রের আসলে যা আবিষ্কার তা হল— বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। এক কথায় উদ্ভিদজীবন প্রাণীজীবনের ছায়া মাত্র। দ্বিতীয় উত্তরটি সম্পর্কেও বেশিকিছু বলা যাবে না। কেননা বিষয়টি বুঝতে হলে বিদ্যুৎ-তরঙ্গ সম্পর্কে এমন সব Technical বা প্রায়ােগিক কথায় আসতে হবে যেগুলাে সবার পক্ষে বােঝা সম্ভব নয়। তাই এখানে সরাসরিভাবে এটুকু বলেই শেষ করতে চাই যে, মার্কনি আধুনিক শর্টওয়েভ-মাপের বেতার-তরঙ্গ ব্যবহার করে দূরে বেতার-সংকেত পাঠাবার কাজেই নিযুক্ত ছিলেন— যার ফলশ্রুতি হল রেডিও; আর জগদীশচন্দ্র মাইক্রোওয়েভ অর্থাৎ অতিক্ষুদ্র বেতার-তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেছিলেন, যার প্রয়ােগ ঘটেছে আধুনিককালের টেলিভিশন, রাডার প্রভৃতি যােগাযােগের ক্ষেত্রে।
Acarjo Jogodishcandro Bosu ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে তাঁর পরিবারের প্রকৃত বাসস্থান ছিল। তার পিতা ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী ভগবান চন্দ্র বসু তখন ফরিদপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে পড়াশোনা করে ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। এই কলেজে ইউজিন ল্যাফন্ট নামক একজন খ্রিষ্টান যাজক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের ওপর তাঁর আগ্রহ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এরপর তিনি আইসিএস পরীক্ষায় বসার জন্য ইংল্যান্ডে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ভগবান চন্দ্র এতে রাজী হননি কারণ তিনি চেয়েছিলেন তাঁর পুত্র একজন বিদ্বান হোন। বাবার ইচ্ছা ও তার আগ্রহে তিনি ১৮৮০ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞান পাঠের উদ্দেশ্যেই লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান, কিন্তু অসুস্থতার কারণে বেশিদিন এই পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। তাঁর ভগ্নীপতি আনন্দমোহন বসুর আনুকুল্যে জগদীশ চন্দ্র প্রকৃতি বিজ্ঞান সম্বন্ধে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ট্রাইপস পাশ করেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি পাঠ সম্পন্ন করেন। কেম্ব্রিজে জন উইলিয়াম স্ট্রাট, ৩য় ব্যারন রেলি, মাইকেল ফস্টার, জেমস ডেওয়ার, ফ্রান্সিস ডারউইন, ফ্রান্সিস মেটল্যান্ড বালফুর, সিডনি ভাইনসের মতো বিখ্যাত বিজ্ঞানসাধকেরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন। একজন বাঙালি পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ ও জীববিজ্ঞানী এবং প্রথম দিকের একজন কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা। তাঁর গবেষণার ফলে উদ্ভিদবিজ্ঞান শাখা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে এবং ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের সূচনা হয় তাঁর হাত ধরে। তিনি আঠারো মাসের সেই গবেষণার মধ্যে মুখ্য ছিল অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ নিয়ে গবেষণা। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ সৃষ্টি এবং কোন তার ছাড়া এক স্থান থেকে অন্য স্থানে তা প্রেরণে সফলতা পান। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞনী হের্ৎস প্রতক্ষভাবে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন। এ নিয়ে আরও গবেষণা করার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন যদিও শেষ করার আগেই তিনি মারা যান। জগদীশচন্দ্র তার অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করে সর্বপ্রথম প্রায় ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট তরঙ্গ তৈরি করেন। এ ধরণের তরঙ্গকেই বলা হয়ে অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ।আধুনিক রাডার, টেলিভিশন এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে এই তরঙ্গের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাঁকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করে। ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তার বক্তৃতার বিষয় ছিল "অন ইলেকট্রিক ওয়েভ্স"। মাত্র ১৮ মাসের মধ্যে করা পরীক্ষণগুলোর উপর ভিত্তি করেই তিনি বক্তৃতা করেন যা ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চমৎকৃত ও আশ্চর্যান্বিত করে। অশীতিপর বৃদ্ধ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন বক্তৃতা শোনার পর লাঠিতে ভর দিয়ে এসে জগদীশের স্ত্রী অবলা বসুকে তার স্বামীর সফলতার জন্য অভিবাদন জানান। তিনি ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭ (বয়স ৭৮) গিরিডি, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারতে মৃত্যু বরর্ণ করেন।