ভক্তমাল গ্রন্থ প্রসঙ্গে ভক্তমাল বৈষ্ণবদের একখানি ধর্মগ্রন্থ। প্রায় সকল শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থের সহিত সংশ্লিষ্ট চারিটি অতি প্রয়োজনীয় বস্তু থাকে—বিষয়, প্রয়োজন, সম্বন্ধ এবং অধিকারী। এই চারিটিকে বলে অনবধ চতুষ্টয়। তুঃ- "অধিকারী চ বিষয়ঃ সম্বন্ধশ্চ প্রয়োজনম্ । শাস্ত্রারম্ভফলং প্রাহরন, বদ্ধচতুষ্টয়ম্ ॥” গ্রন্থটির আলোচ্য বস্তু বা প্রতিপাদ্য বিষয়, গ্রন্থের প্রয়োজন বা উদ্দেশ্য, গ্রন্থের আলোচ্য বস্তুর সঙ্গে উদ্দেশ্যের সম্বন্ধ বা সংগতি এবং উক্ত গ্রন্থপাঠের যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি--এই কয়টি বিষয় মনোমধ্যে রাখিয়া গ্রন্থকার গ্রন্থ রচনা করিলেই তাহা সার্থক হয় । এই ভক্তমাল গ্রন্থটির নামের ভিতর দিয়াই ইহার আলোচ্য বিষয় সূচিত হইতেছে। ভক্তদের মালা অর্থাৎ সমূহে যাহাতে, অর্থাৎ যে গ্রন্থে অসংখ্য ভক্তের বিচিত্র জীবনচরিত বর্ণিত হইয়াছে— ইহাই ভক্তমাল গ্রন্থের নামগত অর্থ। এই গ্রন্থে বৈষ্ণব ভক্তদের চরিত এবং প্রসঙ্গক্রমে বৈষ্ণবের কর্তব্য, অকর্তব্য, ভক্তির লক্ষণ শ্রীরাধাকৃষ্ণের লীলারস এবং শ্রীবৃন্দাবন ধামের বর্ণনা ইত্যাদি সন্নিবেশিত হইয়াছে । শ্রীভগবানের প্রতি ভক্তি ও ভক্তদের প্রতি আকর্ষণের সঞ্চার এই গ্রন্থের উদ্দেশ্য বা প্রয়োজন। যাঁহার মন সাধন ভজন কীর্তন ইত্যাদি দ্বারা মার্জিত হইয়াছে এবং কুতর্ক কয়ক্তি ইত্যাদির পাশ ছিন্ন করিয়া শ্রদ্ধাষ ত্ত হইয়াছে তিনিই এই গ্রন্থপাঠের অধিকারী বা অভিপ্রেত যোগ্য ব্যক্তি। ভক্ত ভক্তমাল গ্রন্থে ভক্তিধর্মেরই প্রাধান্য বিবৃত হইয়াছে, জ্ঞানের নহে। সাধনমার্গে ভক্তি ও জ্ঞान এই দুইটির মধ্যে মূলতঃ পার্থক্য রহিয়াছে। ভক্তি হৃদয়ের ধর্ম, হৃদয়ের আবেগ ও উচ্ছাস হইতে ইহার উদ্ভব আর জ্ঞান হইল মনের ধর্ম, যুক্তিতর্ক বিচার ইত্যাদি ইহার প্রধান অবলম্বন। তাহার হৃদয়ের আকুলতার দ্বারা তাহার প্রিয় শ্রীভগবানকে পাইতে চায়, আর জ্ঞানী চায় নিরাকার, নিগণ, নির,পাধিক ব্রহ্মকে উপলব্ধি করিতে। ভক্ত বলে, “তুমি সন্দর তাই তোমার বিশ্ব সন্দর শোভামর", জার জ্ঞানী বলে, “ব্রহ্মই সত্য, জগৎ মিথ্যা, সেই ব্রহ্ম মনের অগোচর, বাক্যের অগোচর —মনে তাঁহাকে ধারণা করা যায় না, বাক্যে তাঁহাকে প্রকাশ করা যায় না। সূতরাং এইদিক দিয়া জ্ঞান ও তাঁর পর বিরোধী।” যুক্তিবাদী বিচার দ্বারা ব্রহ্ম সম্বন্ধে অনেক কথা জানিলেও মর্মে মর্মে প্রায়শঃ তাহা উপলব্ধি করিতে পারে না, তাহার ব্রহ্মজ্ঞান শধু, পস্তকগত বা গরম খগতই থাকিয়া যায়। কিন্তু ভক্ত কোনর,প ক্তিতর্ক বিচারের ধার ধারে না, সরল বিশ্বাসে গল্পের উপদেশ অনন্যায়। শ্রীভগবানের ভজনা করে। ভগবানকে না পাইলেও তাঁহার জন্য যে নিষ্ঠা ও আকুলতা জন্মে সেইট,কুই তাহার লাভ। ভক্তমাল গ্রন্থ এইরূপে ভক্তদের জন্যই বিরচিত। সেই জন্যই ইহাতে ভক্তদের নানারূপ অলৌকিক কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে, যাহাতে তাহাদের মন ভক্তির পথে সবলে আকৃষ্ট হয়। জড়বাদীর নিকট যাহা অবিশ্বাস্য, ভক্তের নিকট তাহাই ভক্তিরসের উদ্দীপক। সতরাং ভক্তের নিকটই ভক্তমাল গ্রন্থের সার্থকতা, অপরের নিকট নহে। শ্রীচৈতন্যদেব কর,ণা করিয়া কলিতে আবির্ভূত হইলেন, জগতে শৃঙ্গার রস বিশিষ্ট ভক্তিরস প্রচারের জন্য। ইহার তাৎপর্য হইল এই যে শ্রীভগবান্ কে আমরা শখে, ভক্তি করিব না, তাঁহাকে অতি আপন জন করিয়া লইয়া ভালবাসিব – জগতের যতগুলি প্রীতির সম্বন্ধ আছে, নিজের অধিকার অন্যায়ী সেই সেই সম্বন্ধ তাঁহার সঙ্গে স্থাপন করিব। শান্ত সমাহিত ভাবে তাঁহাকে ভালবাসিব, তাঁহাকে প্রভু মনে করিয়া অননুগত ভৃত্যের মত ভালবাসিব, সখা মনে করিয়া হৃদয় বিনিময় করিব, সন্তান ভাৰিয়া স্নেহ কৱিৰ অথবা প্রিয়তম মনে করিয়া মনপ্রাণ দেহ দিয়া তাঁহার সেবা করিব, তাঁহার সঙ্গে আনন্দ করিব, মান অভিমান, তাড়ন, ভৎসন ইত্যাদিও করিব। . এই পাঁচটি ভাবের নাম শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। মধুর বা শৃঙ্গার রস সব রসের শ্রেষ্ঠ। শ্রীচৈতন্যদেব রাধাভাবে বিভাবিত হইয়া সেই উজ্জল বা মধর রস নিজের ভিতর দিয়া প্রকাশ করিলেন, এবং জগদবাসীকে তাহার পথ দেখাইলেন। এই যে শৃঙ্গার রস বা আনন্দ রস তাহা সচ্চিদানন্দস্বরূপে শ্রীভগবান্ স্বয়ং আস্বাদন করিলেন শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা এই দই বিগ্রহে বিভক্ত হইয়া। সখী ভাবাবিষ্ট ভক্ত তাঁহার প্রিয় শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলন, বিচ্ছেদ, মান, প্রণয়, কলহ ইত্যাদি ঘটাইয়া অর্থাৎ অন্তরে উপলব্ধি করিয়া পরমানন্দ ও পরমার্থ লাভ করিয়া থাকেন। মায়াময় জগতের অনিত্য সংখসম্ভোগ আর তাঁহাকে বাঁধিতে পারে না। ভক্তপ্রবর নাভাজী এবং তাঁহারই অনসরণে শ্রীলালদাস শ্রীরাধাকৃষ্ণের সেই লীলারস এই গ্রন্থে সরলভাবে বর্ণনা করিয়াছেন, কোনরূপ তত্ত্ববিচারে প্রবৃত্ত হন না। তত্ত্ববিচার হয় পরের সঙ্গে বা বহিরঙ্গ জনের সঙ্গে; আত্মজনের কাছে বা শ্রদ্ধাশীল ভক্তের কাছে তাহার প্রয়োজন হয় না। এই সরলতার জন্যই ভক্তমাল গ্রন্থ বৈষ্ণব সাধকদের পরম আদরের বস্তু এবং তাহাদের সাধনপথের দীপবর্তিকা। সতরাং শ্রীনাভাজী ও তদন,গামী শ্রীলালদাসের ভক্তমাল গ্রন্থবিরচন সর্বতোভাবে সার্থক।
Title
শ্রীশ্রীভক্তমাল গ্রন্থ ও সাধক মহাপুরুষদের জীবন কথা (রাজ সংস্করণ)