আমাদের দেশ ছিলাে রুখাে কর্কশ গাছপালা প্রায় নেই। খুব বড়াে বড়াে মাঠ তেপান্তর যাকে বলে। গরমের দিনে ঘাস জ্বলে যায়। মাটির রং হয় পােড়া তামাটে শরতে সেই মাটিকেই দেখি হাড়ের মতাে শাদা। তবে বর্ষায় কুচকুচে কালাে রং-এর মাটিও দেখেছি তিন মাইল চার মাইল লম্বা মাঠ ন্যাড়া। এরই মধ্যে মাঝে মাঝে বিপুল শক্তি নিয়ে বিশাল বট বা অশ্বখ দাঁড়িয়ে আছে। মহীরুহ তাদের প্রায় সবাই শতাব্দী পেরিয়েছে এদেরও অবশ্যি নতুন প্রজন্ম আছে। কচি বট অশ্বখ। কেউ তাদের গায়ে হাত না দিলে অবহেলায় শত বছর পরমায়ু পাবে। এইরকম বিরল কিছু বড়াে গাছ বাদ দিলে খােলা মাঠে বনকুল, শেয়াকুল, ভয়ানক রাগী জাতের ফনিমনসা কিছু কিছু দেখা যায়, তাদের গায়ে তামাটে ধুলাের পুরু আস্তর, বােশেখ জষ্টির রােদে ওৎ পাতা ভালুকের মতাে হুমড়ি খেড়ে পড়ে আছে। এই হলাে রাঢ়। কি নির্দয় শুকনাে কঠিন রাঢ়। আমাদের দেশ মধ্যরাঢ়। পশ্চিমে মঙ্গলকোট। গায়ে আগাগােড়া পুরননার ছাপ। মজা দিঘি, পােকায় খাওয়া দাঁতের মতাে ক্ষয় পাওয়া বটগাছ, পাতলা পাটালির মতাে ইটে গাঁথা বাড়িঘর; দালান-কোঠা মাটির তলায় সেঁধিয়েছে। মঙ্গলকোটের গায়ে অজয় নদী শুকিয়ে গেছে। বছর পাঁচেক আগে, শীতের এক সকালবেলায় বড়াে বড়াে দানার লাল বালি পার হয়ে অজয়ের হিম ঠান্ডা পানিতে নেমেছিলাম। পানি হাঁটুর উপর ওঠেনি। আমার তিনদিন স্নান হয়নি—ধুলােয় আগাগােড়া ঢাকা। বরফের মতাে ঠান্ডা পানি আঁজলা ভরে নিয়ে মুখে ঝাপটা দিয়েছিলাম। ওপারে বােলপুরের বাস-সড়কের নিচে অজয়ের উঁচু পাড়ে তেলেভাজার দোকানে বারাে-চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে চমৎকার আলুর চপ ভেজে খাইয়েছিলাে মনে আছে। এমন আক্রার দিনেও ভারি শস্তা। পুবে মালডাঙা। পুরনাে জমি। দেশে জমির খুব অভাব—তাই লােকে আবাদ করে, নইলে এ জমি এমন পাথর, এমন কঠিন রসকষহীন যে আবাদ হতাে না। চারদিকে উঁচু উঁচু টিলার মতাে। প্রায় গিরি গােবর্ধন। খুবই পুরনাে ডাঙা। নদী প্রায় নেই। যা আছে লােকে তাকে কাঁদর বলে। সরু সরু গভীর খাতের নালা বর্ষায় তীব্র স্রোত ।
সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের গৌরবময় একটি নাম হাসান আজিজুল হক। ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বর্ধমান জেলার যবগ্রামে তার জন্ম । নিজের গ্রাম থেকে স্কুলের পড়া সাঙ্গ করে ওপার-বাংলায় চলে যান। তিনি, দর্শনশাস্ত্রের পড়াশোনার পর অধ্যাপনা করেন সেখানকার কয়েকটি কলেজে। ১৯৭৩ সাল থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক, এখন অবসরপ্রাপ্ত। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘকাল অনেক গল্পের স্ৰষ্টা তিনি। গল্প অনেক লিখেছেন, কিন্তু, রহস্যময় কোনো কারণে, উপন্যাস-লেখায় বিশেষ আগ্ৰহ দেখান নি প্ৰতিভাবান এই কথাসাহিত্যিক । এ-বইটি প্ৰকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকসমাজের উৎসুক প্রতীক্ষার যেন অবসান হলো, আমাদের হাতে এসে পৌঁছল হাসান আজিজুল হকের হৃদয়স্পশী এই উপন্যাস : ’আগুনপাখি’ ।