"মালঞ্চ" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ মালঞ্চ রবীন্দ্রনাথের শেষপর্যায়ের উপন্যাস। উপন্যাসটি পরিসরে ক্ষুদ্র ও একমুখী এবং ব্যঞ্জনায় তীব্র। নীরজা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে বিংশ শতাব্দীর আধুনিক মানুষের জীবন কামনা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিয়তি ও বঞ্চনার জগৎ আলােড়িত হয়েছে। মালঞ্চের ভাষারীতি কবিত্বময় ও মাধুর্যপূর্ণ, তবে উচ্ছাসপ্রবণ নয়। ভাষার খাজে খুঁজে ইঙ্গিত আছে, তবে অস্পষ্টতা নেই। ভাষার ক্ষেত্রে কবিতা ও গদ্যের একটি সুষম ভারসাম্য লক্ষ্য করা যায়। মালঞ্চ উপন্যাসটি তত্ত্ব ও ভাবের ভারে ভারাক্রান্ত নয়। সরাসরি লেখক পদার্পণ করেছেন জীবন, বাস্তবতা ও নির্মমতার জগতে। চিত্ররূপময় কল্পনায় রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা-যে কতটা ঐশ্বর্যশালী তার প্রমাণ মালঞ্চের প্রতিটি স্তবকে। নীরজার আজকালকার মনখানা বাদুড়ের চঞ্চক্ষত ফলের মতাে; ভদ্র প্রয়ােজনের অযােগ্য। “বিছানার সামনে জানালা খােলা, তপ্ত হাওয়ায় আসছে মুকুন্দ ফুলের গন্ধ, কখনাে বাতাবি ফুলের নিশ্বাস যেন তার সেই পূর্বকালের দূবরর্তী বসন্তের দিন তাকে মৃদুকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করছে, কেমন আছ? কুকুরটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে লেজের কুণ্ডলীর মধ্যে নৈরাশ্যকে বেষ্টিত করে দ্বারের কাছে পড়ে থাকত। নীরজার ঈর্ষা ও স্মৃতিময় অতীতের প্রজ্বলন এবং বাগানের আশ্চর্য উপস্থিতি— এই উপন্যাসটির প্রাণস্পন্দন। অন্য সব চরিত্র তুলনামূলকভাবে প্রাণহীন ও শীতল। একটি বাগানের জীবন্ত গাছপালার নিশ্বাস, বিচিত্র ফুলের স্পর্শ, ঘাস, ফুল, ফলের মদির অস্পষ্ট সুগন্ধ মেশানাে বাতাস বইটি পড়তে গিয়ে সর্বক্ষণই অনুভব করা যায়। এই উপন্যাসের পাত্রপাত্রীর জীবনে যে নিষ্ঠুরতম খেলা চলছে বাগানের সজীব উপস্থিতি ছাড়া তা অসহনীয় মনে হত। তাই মালঞ্চ উপন্যাসটিতে মালঞ্চ একটি অনিবার্য বিষয়। নীরজা ও আদিত্য-এর দাম্পত্যজীবন ছিল সব অর্থেই ব্যতিক্রমী, মধুর। স্বামী আদিত্য বাগানের ব্যবসায় নাম করেছিল। আর এই বাগানের পরিচর্যা ও প্রেমে নীরজার ছিল দক্ষ সহযােগিতা। এখানকার ফুলে পল্লবে দুজনের সম্মিলিত আনন্দ নব নব রূপ নিয়েছে নব নব সৌন্দর্যে। বিশেষ বিশেষ ডাক আসবার দিনে বন্ধুদের কাছ থেকে প্রবাসী যেমন অপেক্ষা করে চিঠির, ঋতুতে ঋতুতে তেমনি ওরা অপেক্ষা করেছে ভিন্ন ভিন্ন গাছের পুঞ্জিত অভ্যর্থনার জন্য। তাদের দাম্পত্যজীবনের নিটোলতা প্রথমবারের মতাে টাল খায়— যখন ভূমিষ্ঠ হতে গিয়ে তাদের প্রথম সন্তান মারা যায় এবং নীরজা তার স্বাস্থ্য ও সুস্থতা হারিয়ে শয্যাশায়ী জীবনে বন্দি হয়ে পড়ে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।