"প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার"বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: ‘কুকুর এবং ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’-হ্যা, এই লাইনটিই লেখা ছিল একটা সাইনবাের্ডে। সেটা ছিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরােপিয়ান ক্লাবের সাইনবাের্ডে। তখন এতটাই অবহেলা আর তুচ্ছতাচ্ছিল্যের মধ্যে ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। ইউরােপিয়ান ক্লাবটি দখল করতেই শহীদ হন আমাদের এই ভগ্নি। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-১৯৩২)। ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নারী মুক্তিযােদ্ধা এবং প্রথম বিপ্লবী মহিলা শহীদ। তৎকালীন পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া এই। বাঙালি বিপ্লবী সূর্যসেনের নেতৃত্বে তখনকার ব্রিটিশবিরােধী সশস্ত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং জীবন বিসর্জন দেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়তলী ইউরােপিয়ান ক্লাব দখলের সময় একটি বিপ্লবী দল পরিচালনা করেন। দলটি ক্লাব আক্রমণ করলে পুলিশ তাদের আটক করে। পুলিশের হাতে আটক এড়াতে প্রীতিলতা। সায়ানাইড খেয়ে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। র্পৃতিলতা তখন সবে একুশ বছরের তরুণী। চট্টগ্রামের ধলঘাটের এই মেয়েটিকে সবাই ডাকতাে রানী বলে। পরে একটা ছদ্মনামও অবশ্য নেন-ফুলতার। বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানী। ছয় ভাইবােনের সংসারে মা প্রতিভাদেবী ছিলেন গৃহিণী। প্রীতিলতা ছিলেন অন্তর্মুখী, লাজুক এবং মুখচোরা স্বভাবের। ছেলেবেলায় ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা এসব কাজে মাকে সাহায্য করতেন। আর সেই মেয়েটিই কিনা দেশের স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিল! সেটা অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময়। শিক্ষিকা উষাদির সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক ছিল তাঁর। তখনই মনে মনে ধীরপ্রতিজ্ঞ হন। এর মধ্যে হাতে এলাে ঝাঁসির রানী লক্ষ্মীবাঈ-এর জীবনী। এটি পড়ে নিজের ভেতরে বয়ে গেল একটা বিপ্লবী চেতনার ঝড়। এরপর মাসতুতাে দাদার সংস্পর্শে এসে পড়ে ফেললেন আরও অনেক বিপ্লবী চেতনার বই। এর মধ্যে পেলেন লীলা নাগের (১৯০০-১৯৭০) সহযােগিতা। যােগ দিলেন তাঁর দিপালী সংঘে। ১৯৩০ সালে কলকাতার বেথুন কলেজে পড়ার সময় কল্পনা দত্তের (১৯১৩-১৯৯৫) সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। দেখা মেলে বিপ্লবের দায়ে ফাঁসির আসামি রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে। তখন প্রীতিলতার ভেতরে চেতনার আগুনটা আরাে লাল হয়। আলিপুর জেলে বন্দি ছিলেন রামকৃষ্ণ। অমিতা দাস’ ছদ্মনামে কাজিন’ সেজে চল্লিশবার তাঁর সঙ্গে দেখা করেন প্রীতিলতা। এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, তাঁর (রামকৃষ্ণ বিশ্বাস) গাম্ভীর্যপূর্ণ চাউনি, খােলামেলা কথাবার্তা, নিঃশঙ্ক চিত্তে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা, ঈশ্বরের প্রতি অটল ভক্তি, শিশুসুলভ সারল্য, দরদীমন এবং প্রগাঢ় উপলব্ধিবােধ আমার উপর গভীর রেখাপাত করলাে। আগের তুলনায় আমি দশগুণ বেশি কর্মতৎপর হয়ে উঠলাম। রামকৃষ্ণের ফাঁসির নয় মাস পর চট্টগ্রামে ফিরে প্রীতিলতা দেখেন বাবার চাকরি নাই। নিজে বেছে নেন শিক্ষকতা। বিপ্লবী সূত্রে এই চট্টগ্রামেই দেখা হয় নির্মল সেনের সঙ্গে (১৮৯৮-১৯৩২)। এভাবেই মাস্টারদা সূর্যসেনের (১৮৯৪-১৯৩৪) সঙ্গে প্রীতিলতার দেখা। এই সাক্ষাতের কথাটি সূর্যসেন লিখেছেন এভাবে, একজন উচ্চশিক্ষিত কালচারড লেডি একটি পর্ণকুটিরের মধ্যে আমার সামনে এসে আমাকে প্রণাম করে উঠে বিনীতভাবে আমার দিকে দাঁড়িয়ে রইল, মাথায় হাত দিয়ে নীরবে তাকে আশীৰ্বাদ করলাম। পরে ধলঘাট গ্রামে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন প্রীতিলতা। • এখানে সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষের ফলে মাস্টারদা তাঁকে পালাতে নির্দেশ দেন। ‘চট্টগ্রামে সৈন্য ও বিপ্লবীদের সংঘর্ষ' শিরােনামে ধলঘাট সংঘর্ষের খবরটা ১৫ জুন ১৯৩২ সালে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, গতরাত্রে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়ার নিকটে বিপ্লবী ও সৈন্যদের এক সংঘর্য হইয়া গিয়াছে। ফলে গুর্খা বাহিনীর ক্যাপ্টেন ক্যামেরন ও দুইজন বিপ্লবী নিহত হইয়াছেন। বিপ্লবীদের নিকট দুইটি রিভলবার ও গুলি ইত্যাদি পাওয়া গিয়াছে। নিহত বিপ্লবীদের একজনকে নির্মল সেন বলিয়া সনাক্ত করা হইয়াছে। প্রীতিলতার আত্মগােপনের খবর ১৩ জুলাই ১৯৩২ আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁকে ধরার জন্য বেঙ্গল পুলিশের সিআইডি কর্তৃক প্রকাশিত ছবিসহ Caillocat tatt 9, 'Waddadar, whose photographs are published above. Photograph No 1 was taken 2 years ago when Miss Prithi was a student of the Dacca Eden Intermediate College and photograph No. 2 (sitting postures), which is a more recent one, was found at the time of search of one Apurba Sen alias Bhola (since deceased), in connection with Dhalghat shooting affray at Chittagong. ' ২৪ সেপ্টেম্বর মাস্টারদার নির্দেশে ইউরােপিয়ান ক্লাব আক্রমণের সময় প্রীতিলতার পরনে ছিল মালকোঁচা ওয়া ধুতি আর পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা পাগড়ি, পায়ে রবার সােলের জুতা। অবশেষে মৃত্যুর মধ্য দিয়েও হারেননি এই অগ্নিকন্যা। তাঁর এই নিবেদিত আত্মদান আজো আমাদের স্বদেশপ্রেমের ভিত মজবুত করে, উপলব্ধি ধীর করে, আমাদের সামনে তুলে ধরে মুক্তিকামী জীবনের ছবি। তরুণ লেখক ঈশান সামী এই শক্তিরূপিণীর জীবনী অনন্যভাবে এঁকেছেন বইটিতে। আশাকরি, এই বই হয়ে উঠবে আমাদের মুক্তির পরিচয়।