বাংলা ১৩৩৬ সালে ঢাকার 'মুসলিম সাহিত্য সমাজে' গ্যেটে সম্বন্ধে একটি প্রবন্ধ পাঠ করি। সেই প্রবন্ধটি কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে এই গ্রন্থে অবতরণিকা রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। বলা বাহুল্য গ্যেটের বিরাট জীবন ও সাহিত্য সম্বন্ধে এই ক্ষুদ্র প্রবন্ধ লিখে আদৌ সন্তুষ্ট হতে পারিনি। তাই কল্যাণীয় আবদুল কাদির যখন ১৩৩৭ সালে তাঁর “জয়তী” প্রকাশ করেন তখন তাতে গ্যেটের কিছু বিস্তৃত পরিচয় দিতে চেষ্টা করি। জয়তী বন্ধ হয়ে গেলে প্রদীপ-এ ও পরে ছায়াবীথি-র কয়েক সংখ্যায় এই লেখা চলে। এইভাবে ধীরে সুস্থে ১৩৪১ সাল পর্যন্ত গ্যেটের প্রথম জীবনের পরিচয় একরকম দেওয়া হয়। সেই দিনে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের প্রিন্সিপাল সাহিত্য-রসিক শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র মহোদয় আমার জন্য গ্যেটে সম্বন্ধে কয়েকখানি মূল্যবান গ্রন্থ সংগ্রহ করেছিলেন, তাঁর সেই প্রীতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। প্রায় সাত বৎসর পরে পুনরায় গ্যেটের আখ্যায়িকা আরম্ভ হয়— প্রধানত আবদুল কাদিরের আগ্রহে আর শিশমহলের তরুণ সম্পাদকের তাগিদে। শিশমহল বন্ধ হয়ে যেতে দেরি হয়নি। কিন্তু এই মহাজীবনের প্রতি আমার নবীভূত অনুরাগ যে মন্দীভূত হয়নি এজন্য নিজেকে ভাগ্যবান জ্ঞান করছি। গ্যেটে সম্বন্ধে বাংলাভাষায় কোনো গ্রন্থ নেই বললেই চলে— তেমন বিস্তৃত আলোচনাও নেই। কিন্তু বাংলার একালের জীবন ও সাহিত্যের সঙ্গে গ্যেটের যোগ নিবিড়। বহুদিন পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র লক্ষ করেছিলেন, গ্যেটের জীবনের সমৃদ্ধি আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর যে যোগ তা এত গভীর যে তাকে আত্মিক যোগ বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশের মাত্র একজন বড় কবি নন, আমাদের একালের বাংলার বা ভারতের জীবনসাধনার শ্রেষ্ঠ পুরুষ। তাঁর সেই সাধনায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে আমাদের অতীত ও বর্তমানের বোধ, ভবিষ্যতের আশা, আর জগতের সঙ্গে আমাদের অচ্ছেদ্য যোগ। এ সম্বন্ধে দেশের চিন্তাশীলরা ধীরে ধীরে সচেতন হচ্ছেন। হয়তো সেই চেতনাই আমাকে দুঃসাহসী করেছে একালের ইয়োরোপের ভাব ও জীবন-খনির এই মহামূল্যবান হীরকের সন্ধানী হতে : এই সুপরিজ্ঞাত ও সুপরীক্ষিত হীরকের সঙ্গে তুলনায় আমাদের নবলব্ধ হীরকের মূল্য ও মর্যাদা উপলব্ধি অপেক্ষাকৃত সহজ হবে এই আশায় আমি আশান্বিত হয়েছি; আর কালে কালে সবাই হয়তো এ বিষয়ে নিঃসন্দেহে হবেন যে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইয়োরোপের যে নবমানবিকতার সাধনা– New Humanism— পাশ্চাত্যে তার শ্রেষ্ঠ ফল গ্যেটে, আর প্রাচ্যে তার শ্রেষ্ঠ ফল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার জাগরণ যার ব্যাপকতম প্রকাশ রবীন্দ্রনাথে।
জন্ম : ২৬ এপ্রিল ১৮৯৪, নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার জগন্নাথপুরে মামার বাড়িতে। পৈত্রিক নিবাস তৎকালীন ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রাম। পিতা কাজী সৈয়দ হােসেন ওরফে সগীরউদ্দীন। মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অন্যতম সংগঠক ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। শিক্ষা : ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৯ সালে এমএ পাস করেন। কর্মজীবন : ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যােগদান। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে টেক্সট বুক বাের্ডের সেক্রেটারি রূপে কলকাতায় যান। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অবসর গ্রহণ। প্রকাশিত গ্রন্থ : নবপর্যায় (প্রথম খণ্ড-১৩৩৩), (দ্বিতীয় খণ্ড-১৩৩৬), রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪), সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১), হিন্দু-মুসলমানের বিরােধ (১৩৪২), আজকার কথা (১৩৪৮), কবিগুরু গ্যেটে (১ম খণ্ড-১৩৫৩), (২য় খণ্ড-১৩৫৩), নজরুল প্রতিভা (১৩৫৫), Creative Bengal (১৯৫০), শাশ্বত বঙ্গ (১৩৫৮), স্বাধীনতা দিনের উপহার (১৯৫১), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (১ম-১৩৬২, দ্বিতীয়-১৩৭৬), বাংলার জাগরণ (১৩৬৩), শরৎচন্দ্র ও তারপর । (১৯৬১), হযরত মােহাম্মদ ও ইসলাম (১৩৭৩)। পুরস্কার : ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে শিশিরকুমার পুরস্কার লাভ। মৃত্যু : ১৯ মে ১৯৭০ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।