বেশ বড় একখানা হলঘর। ওপরে গোটা সিলিং জুড়ে টাঙানো মখমলের চাঁদোয়া। দু'দিকের দেওয়ালে মুখোমুখি প্রমাণ সাইজের দু'খানা বাঁধানো তৈলচিত্র। মনে হয় দু'জন পূর্বপুরুষ। মেঝেয় কাজকরা তক্তপোশে গদির ওপর কিংখাবের চাদর-ঢাকা আসনে বসে আছেন ফৌজদার। তাঁর পিছনে লম্বা তাকিয়া, দু’পাশে পাশবালিশ। হাতে সোনাবাঁধানো রুপোর গড়গড়ায় লাগানো তামাকু সেবনের নল। সামনে হাতির দাঁতের হাতবাক্স, দোয়াত, কলমদান, সীলমোহর, রুপোর পানের ডিবা, তক্তার নিচে রঙিন চীনামাটির পিকদানি। তাঁর ডানদিকে সম্ভ্রান্তদের বসার জন্য কুর্শী, হরেকরকমের ঝালর দেওয়া মোড়া ৷ বাঁদিকে মেঝেতে শতরঞ্জির ওপর ডেস্ক নিয়ে বসে কাজ করছেন মুনশীবাবুরা। গম্ভীর গলায় ফৌজদার শুধালেন, নাম কি? শোভারাম দে। কতদূর পড়েছ? সংস্কৃত পড়েছি, আরবী-ফার্সীও জানি। কোথায় পড়েছ? টোলে পড়েছি, মক্তবেও পড়েছি। উত্তর শুনে ফৌজদার বেশ খুশি হলেন। মেহেদি মাখানো দাড়িতে হাত বুলোতে বুলোতে বলতে লাগলেন, পড়বেই তো, কায়স্থের ছেলে, শাস্ত্রও পড়তে হবে আবার হিসাবও জানতে হবে। তোমার বাবা তো এ অঞ্চলের নামকরা পণ্ডিত ছিলেন। দেওয়ান মুর্শীদকুলি খাঁও তাঁকে সময় অসময়ে স্মরণ করতেন । বাবাকে প্রায় মনেই পড়ে না শোভারামের। মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়েছিল। অনেকক্ষণ ভাবলে আবছা মনে পড়ে। ফর্সা, লম্বা, গোঁফওয়ালা একটি গম্ভীর মুখ। মাথায় রঙিন কাপড়ের পাগড়ি। পরনে আঁটোসাটো ট্রাউজার, তার ওপর হাঁটু পর্যন্ত ঝোলানো লম্বা কোট গায়ে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে কাছারি যাচ্ছেন। যাক্, মনে পড়ুক আর নাই পড়ুক, প্রয়াত পিতার খাতিরেই মাত্র সতেরো বছর বয়সে শোভারামের চাকরি হয়ে গেল পাণ্ডুয়ার (হুগলী) ফৌজদারী সেরেস্তায়। সেইসময় বাংলায় জমিজমা নিয়ে ‘আসলি জামাতুমার' নামে সেট্লমেন্টের কাজ চলছে।