ভ্রমণ-সাহিত্য- ভ্রমণ সাহিত্য ব্যক্তির কোনো অঞ্চলে ভ্রমণ বিষয়ক অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত সাহিত্য। কিন্তু সাহিত্যের বনেদি শাখাগুলো যেমন, কবিতা, নাটক, উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পের মতো ভ্রমণ সাহিত্যকে সবসময় উঁচু মানের সাহিত্য হিসেবে বিবেচনা করতে অনেকে আগ্রহী নয়। দেখা গেছে, বিখ্যাত লেখকদের অনেকেই তাঁদের নিয়মিত সাহিত্যচর্চার অংশ হিসেবে ভ্রমণ-সাহিত্য রচনা করেছেন। প্রথাগত অর্থে ভ্রমণসাহিত্য হচ্ছে সে সাহিত্য, যা পর্যটকের ভ্রমণের অভিজ্ঞতার বিবরণ হয়ে ওঠে। brফলে ভ্রমণ-সাহিত্যের পরিমণ্ডল আন্তর্দেশীয় এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক হয়ে থাকে। ভ্রমণ-সাহিত্য বর্ণনাত্মক, আখ্যানমূলক এবং নিজস্ব শিল্পমান সমৃদ্ধ । ভ্রমণ-সাহিত্য আসলে একধরনের বর্হিমুখী সাহিত্য যার সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেওয়া যায় না। পেঙ্গুইন ডিকশনারি অব লিটারেরি টার্মস এন্ড লিটারেরি থিয়োরি গ্রন্থে সংজ্ঞায়নের চেষ্টা করা হয়েছে এভাবে, A neglected and much varied genre of great antiquity to which many famous, more or less professional or full-time ' writers have contributed, but which has also been enriched by a number of occasional writers. For the most part of these have been diplomats, scholars, missionaries, soldiers of fortune, doctors, explores and sailors. পশ্চিমের দেশগুলোতে ভ্রমণ-সাহিত্য সমাজ-ইতিহাসের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মধ্যযুগে বিশেষ করে রেনেসাঁর সময়ে মার্কো পেলোর মতো পর্যটকদের প্রতিবেদন ইউরোপকে তাদের বাইরের দেশের মানুষ ও জনজীবন সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিলো এবং ইউরোপের বাইরেও যে ভিন্ন সংস্কৃতি আছে তা তারা জানতে পেরেছিলো। সে সময় এসব প্রতিবেদন পাঠকদের কল্পনাশক্তি বাড়িয়েছে, নতুন নতুন দেশ ও জনজীবন আবিষ্কারে উৎসাহ যুগিয়েছে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস রচনায় একইভাবে চীনা পরিব্রাজক হিউয়ের সাঙ-এর ভ্রমণবৃত্তান্ত একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবে বিবেচিত। মজার ব্যাপার হলো, এগুলোর কোনো কোনোটি আবার কল্পনানির্ভর ও কাহিনীমূলক। এ ধরনের একটি বিখ্যাত রচনা হলো স্যার জন মেন্ডেভিলের ভ্রমণগুলো (১৩৭০ খ্রি.)। মেন্ডেভিল পর্যটকদের নানা ধরনের বিচিত্র গল্প ও কিংবদন্তি নির্বিচারে গ্রহণ করেছিলেন, ক্ষেত্র বিশেষে যুক্ত করেছিলেন চাঞ্চল্যকর সব উপাদান এবং পুরো বইটাকে করে তুলেছিলেন রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। বইটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিলো। মূল বইটি লেখা হয়েছিলো ফরাসি ভাষায় পরে ১৩৭৫ সালে এটি ইংরেজিতে অনূদিত হয় এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী জনপ্রিয় গ্রন্থ হিসেবে পঠিত হতে থাকে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।