"ট্রয়ের রমণীরা" বইটির পূর্বলেখ অংশ থেকে নেয়াঃ যুদ্ধ এক মহাঅভিশাপ–পরিণাম বয়ে আনে চরম সংকট ও সর্বনাশ। বিশ্বইতিহাস পরিক্রম করলে দেখা যায় : খৃ.পূ. ত্রয়ােদশ শতকে ট্রয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্প্রতি বসনিয়া, লাইবেরিয়া, ইরাক যুদ্ধ এরই সাক্ষ্য বহন করে। আমার স্মৃতিপটে জেগে ওঠে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের (১৩৩৯-৪৫) বিভীষিকা ও প্রলয়তাণ্ডব, যা সমগ্র বিশ্বে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে— অশুভ পরিণাম বহন করে নিয়ে আসে। এই যুদ্ধে চরম আঘাত হানা হয় জাপানের হিরােশিমা ও নাগাসাকিতে আণবিক বােমার প্রয়ােগের ফলে। অথচ আণবিক বােমার সূত্র-আবিষ্কারক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন এই বােমার ব্যবহার সম্পর্কে বারবার সাবধানবাণী উচ্চারণ করছেন। তিনি জাপানে ধ্বংসযজ্ঞে শিহরিত হয়ে বিশ্বের বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যুদ্ধবিরােধী আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। এই আন্দোলনে তাঁর অন্যতম সহধুরী ছিলেন বিলেতের ব্রার্ট্রান্ড রাসেল। তবু যুদ্ধ থামেনি। রণােন্মত্ত মানুষের এক ভয়াবহ রূপ দেখা গেল পরবর্তীকালে য়ুরােপে, আফ্রিকায় এবং সর্বশেষে মধ্যপ্রাচ্যের ইরাকে। অতএব জীবনের প্রান্তে পৌছে— চার দশকের সাহিত্যসাধনার পর চলমান বিশ্বের আবর্তমুখর প্রেক্ষাপটে মানবকল্যাণে যুদ্ধবিরােধী লেখার তাগিদ অন্তর থেকে অনুভব করি। এরই ফলশ্রুতিতে আড়াই হাজার বছরের বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিরােধী নাটক য়ুরােপিদেস-এর ট্রয়ের "রমণীরা’র রূপান্তর"। অনুবাদের পূর্বে নাটকটি সম্পর্কে জাঁ পল সার্জের উক্তি আমাকে আলােড়িত করে : 'It was a condemnation of war in general and colonial expedition in particular.'
বাংলা সাহিত্যের সাথে বিশ্বসাহিত্যের অন্বয় মােবাশ্বের আলীর অন্বিষ্ট এবং অর্ধ শতক ধরে এই তার ব্রত। জন্ম কুমিল্লায় (১৯৩১) আলাসাহেব বাড়িতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা কুমিল্লা জেলা স্কুলে (১৯৩৮)। কিন্তু তাঁর মানস গড়ে ওঠে আইনজীবী পিতা নেওয়াজেস আলীর সাহচর্যে । বৈশ্বিক মানসের অধিকারী পিতা কিশাের পুত্রকে সেক্সপীয়ার, সারভানটিস, তলস্তয়, বঁল্যার সাথে পরিচিত করে তােলেন। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে এসে (১৯৪৬) তাঁর নীট লাভ হলাে পিতৃদত্ত দু'টি গ্রন্থবিউরি গ্রীসের ইতিহাস এবং ও নীলের ওণশণভ ঐরণণপ ফেট, তরুণ বয়সে। গ্রীসের ইতিহাস ও সাহিত্যের সাথে পরিচিতি তাঁর সাহিত্য জীবনে ফলপ্রসূ হয়। তাঁর মধ্যে বৈশ্বিক ভূমিকার সূত্রপাত ঘটে। '৪৮-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বাংলায় অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেন- ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্ররূপে। '৫১-এ অনার্স, '৫২-তে এম. এ. করে অধ্যাপনা জীবনেও তার বিশ্বসাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা অব্যাহত থাকে। ফলে বাংলা সাহিত্যের বিশ্বজনীন ভূমিকা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। লেখকরূপে তার আবির্ভাব ‘সমকালে। সিকান্দর আবু জাফরের অনুরােধে তার গ্রীক সাহিত্য আলােচনা ও অনুবাদের সূত্রপাত। ক্লাসিক্যাল জগৎ ও রেনেসাঁস য়ুরােপ এবং বিশ্বসাহিত্যকে বাংলায় পরিচিত করে তােলাই তার জীবনগত সাধনা। প্রকাশনার ক্ষেত্রে তার সহায়ক হয়েছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, স্টুডেন্ট ওয়েজ, কাকলী, ঐতিহ্য, মুক্তধারা, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন। তাঁর রচিত গ্রন্থের সংখ্যা চৌত্রিশ। সাহিত্যকৃতির দরুন তিনি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন । বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭৪), কুমিল্লা ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৪), একুশে পদক (১৯৯২), মধুসূদন পুরস্কার (১৯৯৩), বাংলাদেশ মহিলা সমিতি পুরস্কার (১৯৯৫) ইত্যাদি।