অনুবাদকের কথা দুই হাজার ছয় সালের কথা। তখন আমি থাকতাম ঢাকা উত্তরায়। প্রফেসর হামিদুর রহমান সাহেবের মুহাম্মাদিয়া মাখযানুল উলুম মাদরাসায়। মাদরাসায় প্রতি সোমবার বাদ মাগরিব হযরতের ইসলাহী মজলিস হত। এক সোমবারের কথা। এশার পর মাদরাসার অফিসরুমে গিয়ে দেখি ছোটখাট একটা মজলিস চলছে। মজলিসের মধ্যমণি হয়ে আছেন হযরতের জামাতা, মাকতাবাতুল আশরাফের স্বত্বাধিকারী, জামেয়া ইসলামিয়া তাঁতীবাজার মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান খান সাহেব। তাঁকে ঘিরে আছেন বিশিষ্ট লেখক-অনুবাদক অগ্রজ হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ জালালুদ্দীন সাহেব, প্রিয়তম উস্তাদ টঙ্গী দারুল উলুম মাদরাসার নাযিমে তালিমাত হযরত মাওলানা আবু বকর সাহেবসহ আরও কয়েকজন আলেম। শরীক হলাম আমিও। পিনপতন নীরবতা। আওয়াজ আসছে শুধু হযরত খান সাহেব হুজুরের মুখ থেকে। তিনি একটা উর্দূ কিতাব পড়ছেন। সবাই তা গোগ্রাসে গিলছে। শ্রোতা হলাম আমিও। মোহাচ্ছন্ন হয়ে শুনতে লাগলাম। আল্লাহই ভালো জানেন কী এমন যাদু রয়েছে কিতাবটিতে। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনছে।
হযরত খান সাহেব হুজুর থামলেন। এরপর কিতাবটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিলেন। কিতাবটির নাম ‘দাওয়ায়ে দিল’। পাকিস্তানের বিশিষ্ট বুযুর্গ আলেম, নকশবন্দিয়া সিলসিলার বিখ্যাত মুরশিদ হযরত মাওলানা যুলফিকার আহমাদ নকশবন্দী দামাত বারাকাতুহুমের ইসলাহী বয়ান সংকলন। সংকলনটি করেছেন গুজরাটের দারুল উলুম ফালাহে দারাইন মাদরাসার উস্তাদ হযরত মাওলানা সালাহুদ্দীন সাইফী সাহেব। আত্মশুদ্ধি, চরিত্র গঠন ও বিশুদ্ধ জীবন গঠনের এক অনবদ্য পাথেয় গ্রন্থ। হযরত খান সাহেব মাওলানা নকশবন্দী ও তাঁর এই বয়ান সংকলনটি সম্পর্কে আরও অনেক কথা বললেন। প্রকাশ করলেন অসাধারণ অনুভূতি।
এক পর্যায়ে কিতাবটি হাতে নেয়ার সৌভাগ্য হল। নেড়ে চেড়ে দেখলাম। তাঁদের আলোচনার মাঝেই দুয়েক প্যারা পড়লাম। পড়ার নেশা ধরে গেল। কিন্তু কিতাবটি যে এই মুহূর্তে এমনকি আরও দু’এক সপ্তাহের মধ্যে স্বাধীনভাবে দেখতে পারব না, পড়তে পারব না এমনকি হাতেই পাব না, সে ব্যাপারে নিশ্চিতই ছিলাম। এরপরও সাহস করে বইটি ফটোকপি করে নেয়ার আবদার করলাম। হযরত খান সাহেব হুজুর বললেন, ফটোকপি করে নিতে পারবেন, কিন্তু অনুবাদ করার অনুমতি নেই। অনুবাদ আমি নিজেই করব। এ বিষয়ে এমন কিতাব আর একটিও দেখিনি। যত কষ্টই হোক এবং যত ব্যস্তই থাকি, বইটি আমিই অনুবাদ করব এবং খুব উন্নত অফসেট কাগজে প্রকাশ করব। আমি বললাম, ঠিক আছে, অনুবাদ আপনিই করেন, সমস্যা নেই। আমি করব না। আমি শুধু মনভরে পড়ার জন্য এবং মূলকপিটি সংগ্রহে রাখার জন্য ফটোকপি করে নেব। যাহোক, হযরতের অসামান্য স্নেহ যে, তিনি নিজের টাকা দিয়ে বইটি ফটোকপি করে আমাকে এক কপি হাদিয়া দিয়েছিলেন। জাযাকাল্লাহ। এরপর আরও বেশ কিছুদিন অতিবাহিত হয়। ইতিমধ্যে মাকতাবাতুল আশরাফ থেকে আমার অনূদিত ‘নামাযের হাকীকত’ ও ‘মহানবী সা. যেভাবে নামায পড়তেন’ বই দু’টি প্রকাশিত হয়েছে। কাজ শেষ হয়েছিল মুফতী মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমের ‘নুকুশে রফতেগাঁ’র অনুবাদও। কাজ করছিলাম ‘হায়াতুল আবরার’-এর একটি অংশের। এর মধ্যে একদিন তিনি আমাকে বললেন, খুব ইচ্ছা ছিল ‘দাওয়ায়ে দিল’ কিতাবটা আমিই অনুবাদ করব। কিন্তু কোন কিছুতেই সুযোগ হয়ে উঠছে না। আপনি যদি খুব অল্প সময়ে অনুবাদ করে দিতে পারেন, তবে কাজটি করতে পারেন। সময় বেশি লাগলে অন্য কাউকে দেব।
হযরতের প্রস্তাব ছিল আমার কাছে অকল্পনীয় প্রাপ্তির বিষয়। সাথে সাথে ইনশাআল্লাহ বলে রাজি হয়ে গেলাম এবং এক মাসের কম সময়ের মধ্যে পুরো কিতাবটি অনুবাদ সম্পন্ন করলাম। এরপর কম্পোজ ও প্রাথমিক প্রুফ দেখার পর যখন হযরত খান সাহেবকে পাণ্ডুলিপি জমা দিলাম, তখন তিনি তার বিশেষ নীতিগত ‘মাজুরী’র কথা প্রকাশ করে বললেন, বইটি আমার মাকতাবাতুল আশরাফ থেকে প্রকাশ করতে পারছি না। আপনি অন্য কোন প্রকাশকের সাথে আলোচনা করুন। কেউ রাজি না হলে আমি ব্যবস্থা করে দেব। বাকি আপনি অন্য কাজগুলো দ্রুত সম্পন্ন করে দিন।
বইটি প্রকাশের ব্যাপারে যতটাই স্বপ্ন দেখেছিলাম, ঠিক ততটাই ধাক্কা খেলাম। ধাক্কা খেলাম আরও কয়েকজন প্রকাশক থেকেও। বইটি সবাই প্রকাশ করতে চায়, তবু কেন যেন আলোর মুখ দেখছিল না। এরই নাম হয়তো কুদরতের ফয়সালা। এক পর্যায়ে আমি চুপ হয়ে গেলাম। পাণ্ডুলিপিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখলাম। এর ভেতর আমি কঠিন এক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ি। এক সময় আল্লাহর দয়া এবং শুভাকাক্সক্ষীদের দুআর বদৌলতে সেই কঠিন ব্যাধি থেকে নিরাময় লাভ করি। বলা যায় আল্লাহ তায়ালা নতুন এক জীবন দান করেন আমাকে। লাকাল হামদু ওয়ালাকাশ শুক্রু। ডাক্তারের নির্দেশ পূর্ণ রেস্ট নিতে হবে। মাথায় চাপ পড়ে এমন কোন কাজ করা যাবে না। ফলে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে আমার কলম-খাতা। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি প্রকাশনার জগত থেকে। এরপর যখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠছিলাম, তখন খেলাম আরেক ধাক্কা। হঠাৎ করে আমার কম্পিউটারের হার্ডডিস্কটা ক্র্যাশ করে। ফলে কম্পিউটারের সব কাজ ‘গায়েব’ হয়ে যায়। আজও পর্যন্ত সেই হার্ডডিস্ক ঠিক করা যায়নি এবং লেখাগুলোও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ‘দাওয়ায়ে দিল’-এর অনুবাদও ছিল। কিন্তু আল্লাহর রহম ও করম কোন এক ফাঁকে বইঘরের আমিনুল ইসলাম ভাইয়ের কম্পিউটারে বইটির সফট কপি রেখে দিয়েছিলাম তা আমার নিজেরও মনে ছিল না। গত মাস দুই তিনেক আগে তিনি বিষয়টি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, বইটি পড়ে আছে, অনুমতি দিলে ছাপাতে পারি। বইটি আছে, খবরটি শুনে আমি তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ি। বললাম ঠিক আছে, ছাপান। সেই রেশ ধরে তিনি জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে আমাকে বইটি আরেক নজর দেখে দেয়ার জন্য বলেন এবং আমার জন্য অকল্পনীয় এক খোশখবর দেন। তিনি বললেন, দ্রুত দেখে দিলে এবারের একুশে বইমেলাতেই প্রকাশ করব। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বই প্রকাশ পাওয়া যে কোন লেখকের জন্যই আনন্দের বিষয়।
বইটি প্রকাশের পেছনে অনেকেরই সহযোগিতা রয়েছে। সর্বপ্রথম যার সহযোগিতার কথা স্মরণ করতে হয় সে হল আমার জীবনসঙ্গীনী, জারীরের আম্মু। পুরো বইটি সে নিজ হাতে কপি করেছিল, কম্পোজও করেছিল সে। আল্লাহ তায়ালা তাকে উত্তম জাযা দান করুন। এছাড়াও ভাই তৈয়বুর রহমান, সরওয়ার হোসেনকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। যারা বইটি ভুল-ত্রুটি থেকে মুক্ত করার জন্য অসামান্য কষ্ট করেছেন। স্মরণ করছি, বিশিষ্ট লেখক হযরত মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ ভাইকে। যাঁর কাছে আমি বিশেষভাবে ঋণী। স্মরণ করছি মাকতাবাতুল আশরাফের মালিক হযরত মাওলানা হাবীবুর রহমান খান সাহেবকে। যিনি মূল কিতাবটি নিজে ফটোকপি করে দিয়েছিলেন এবং অনুবাদ করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁদের সবাইকে উত্তম বদলা দান করুন। আমিন। পরিশেষে শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি বইঘরের আমিনুল ইসলাম ভাইয়ের। যিনি বইটি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে এবং আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করছেন।
হে আল্লাহ! আমি কমজোর, দুর্বল। তুমি যে আমাকে একটি দীনী কাজ করার তাওফিক দান করেছো, এজন্য তোমার হাজার শোকর। আল্লাহ! দয়া করে তুমি আমার এই কাজটুকু কবুল করে নাও এবং এর খায়ের ও বরকত আমাদের সবাইকে দান কর। হে আল্লাহ! এ বই প্রকাশের ক্ষেত্রে যে যেভাবে সম্পৃক্ত ছিল, সবাইকে তুমি উত্তম জাযা দান কর এবং এই বইটিকে আমাদের হিদায়াতের উসিলা বানিয়ে দাও।
আবুজারীর আবদুল ওয়াদুদ
সূচিপত্র বয়ান : ১ * আলোকিত হৃদয় * গোশতের একটি টুকরা * কিয়ামতের দিন যা কাজে আসবে * অন্তর এক আজব বসতি * ‘অন্তর’ আল্লাহ তায়ালার তাজাল্লীর স্থান * অন্তর পরিশুদ্ধ করতে বিলম্ব * একটি বিস্ময়কর উপমা * সব অঙ্গ অন্তরের অনুগত * দেখতে ছোট বাস্তবে বড় * একটি উদাহরণ * অন্তর ওয়াকফের সম্পত্তি * সবকিছু দিয়েও অন্তরের মূল্য দেয়া যাবে না * একটি অদ্ভূত উদাহরণ * প্রিয়জনের স্মরণ অন্তরকে অস্থির করে তোলে * অন্তর বিরান করার একটি দৃষ্টান্ত * ঘুমিয়ে যাওয়া ও মরে যাওয়ার মধ্যে পার্থক্য * আত্মার ব্যাধি * আত্মার চিকিৎসক * বসারত ও বসিরতের পার্থক্য * অন্তর কখন শক্ত হয় * দামি * অন্তর কীভাবে যিকিরকারী হবে * একজন মহান মুজাহিদের রাত্রিজাগরণের ঘটনা * তাহাজ্জুদ পড়ার সৌভাগ্য কীভাবে লাভ হবে
জুলফিকার আহমদ নকশবন্দি (জন্ম: ১ এপ্রিল ১৯৫৩) একজন পাকিস্তানি ইসলামি পণ্ডিত এবং নকশবন্দি তরিকার সুফি। তিনি পাঞ্জাব প্রদেশের ‘ঝং’ জেলায় অবস্থিত মাহদুল ফাকির আল ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা। ২০১১ সালে ভারত ভ্রমণ করেন ভারতের হায়দরাবাদের ঈদগাহ বিলালী মনসাব ট্যাঙ্ক ও চঞ্চলগুদা জুনিয়র কলেজে কয়েকটি সম্মেলনে ভাষণ দিয়েছিলেন। তারপরই তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দারুল উলুম দেওবন্দের মসজিদে রশিদ এবং দারুল উলুম ওয়াকফ দেওবন্দের অনুষ্ঠানেও বক্তব্য রাখেন।