রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ বিন সউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুযোগ্য প্রফেসর, সুসাহিত্যিক ড. আব্দুর রহমান রা'ফাত পাশার এই বইখানা আরব বিশ্বের কিশোর-কিশোরী, ছাত্র-ছাত্রীদের ইসলামী জীবন গঠনে সহায়ক একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। একইভাবে ওলামা-মাশায়েখ থেকে শুরু করে সর্বস্তরের পাঠক-পাঠিকাদের নিকটও বইটি বিশেষভাবে সমাদৃত। কলুষিত ও ব্যাধিগ্রস্ত ঘুণে ধরা সেই জাহেলী সমাজের আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ জাতিকে নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার শীর্ষে তুলে কীভাবে কলুষমুক্ত পরশ পাথরে পরিণত করা হয়েছিলো তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ফুটে উঠেছে ‘সাহাবীদের আলোকিত জীবন’-এ। বইটি একেকজন সাহাবীর জীবনের একেক ধরনের স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে মহিমান্বিত। এটি সাধারণ নিয়মে রচিত সাহাবীদের কোনো জীবনীগ্রন্থ নয়; এতে বিশিষ্ট কয়েকজন সাহাবী রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহুমের ঈমানের উপর ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা, কর্মে ত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মহব্বতের পরম পরাকাষ্ঠা, আনুগত্যের অনুপম নিদর্শন, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা ও সহযোগিতার সুমহান আদর্শসহ জীবনের এমনসব চমকপ্রদ স্বকীয় বৈশিষ্ট্য আলোচিত হয়েছে, যা একজন পাঠকের ঈমানী চেতনাকে উজ্জ্বীবিত করবে। লেখক অত্যন্ত উচ্চাঙ্গের আরবী ভাষায় সাহাবীদরে জীবনী সম্বলিত এ বইটি রচনা করেন। আরবী ভাষার গভীরতা, মাধুর্য, প্রাঞ্জলতা ও ভাবের সমন্বয়কে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করার জন্য বইটির হুবহু অনুবাদের আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছে। কোথাও কোথাও শাব্দিক অর্থের সীমারেখা পেরিয়ে ভাবার্থের আশ্রয়ও নিতে হয়েছে। কিছু সংখ্যক সাহাবীর ইসলামপূর্ব বিদ্রোহী জীবনীর সাথে পরবর্তী ইসলামী জীবনের তুলনামূলক চিত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁদেরকে লেখক যেভাবে সম্বোধন করেছেন, অনুবাদেও সেভাবে সম্বোধন করা হয়েছে অর্থাৎ ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথেই তাঁদেরকে রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বলে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়েছে।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর সিরিয়ার আরিহা শহরে জন্ম। জন্মের চার মাসের মাথায় বাবাকে হারান। চার বছর বয়সে মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গেলে দাদার কাছেই লালিত-পালিত হন। সিরিয়ার প্রাচীনতম শরয়ী শিক্ষাগার হালাব শহরের মাদরাসা খুরভিয়ায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন। তারপর মিসরের আল-আজহার ইউনিভার্সিটি থেকে অর্জন করেন উসূলে ফিক্হের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি। আল-আজহারে পড়াশোনা শেষ করে কায়রো ইউনিভার্সিটিতে আরবি ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চতর গবেষণা সম্পন্ন করে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ড. আবদুর রহমান রা‘ফাত পাশা শিক্ষকতা, সাহিত্যসাধনা ও গবেষণাতেই জীবনভর সম্পৃক্ত ছিলেন। এক সময় দামেস্ক ইউনিভার্সিটির কলা অনুষদের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সৌদি আরব সফরে গেলে রিয়াদের ইমাম মুহাম্মদ ইবনে সউদ ইউনিভার্সিটি থেকে অধ্যাপনার প্রস্তাব পেয়ে সেখানেই স্থির হয়ে যান। আরবি ভাষার সেবা, সাহিত্যসাধনা ও গবেষণার পাশাপাশি মুহাম্মদ ইবনে সউদ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সেখানেই কাটিয়ে দেন জীবনের বাকি বাইশটি বছর। ইসলামি সাহিত্যের উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে ড. রা‘ফাত পাশা প্রধানত দুটো ভাগে কাজ করেছেন। এক. ইসলামের স্বর্ণযুগে রচিত দাওয়ামূলক কবিতা সম্ভারকে শিল্পের নিক্তিতে মেপে সমালোচনা। দুই. ইসলামের অতীত ইতিহাসকে খ্যাত ও বিস্মৃত মনীষীদের জীবনীর আদলে অনন্য রচনাশৈলিতে উপস্থাপন।জীবনী সাহিত্যে রা‘ফাত পাশা যে কাজগুলো করে গেছেন, তা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। ‘সুয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবা’, ‘সুয়ারুম মিন হায়াতিস সাহাবিয়াত’ ও ‘সুয়ারুম মিন হায়াতিত তাবেয়িন’ শিরোনামের তিনটি গ্রন্থ তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এ ছাড়া ‘আদ-দীন আল-কাইয়িম’, ‘লুগাত আল-মুসতাকবিল’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ আরও বিপুল কাজ করে গেছেন তিনি। ৬৬ বছর বয়সে প্যারালাইসিসের কারণে ড. রা‘ফাত পাশার শরীরের একাংশ বিকল হয়ে যায়। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময় ডাক্তারের পরামর্শে কিছু দিনের জন্য হাওয়া বদলের উদ্দেশে তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যান এবং সেখানেই জুলাইয়ের ১৮ তারিখ মুতাবেক ১১ জিলক্বদ ১৪০৬ হিজরী শুক্রবার রাতে ইন্তিকাল করেন। ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক ‘ফাতেহা’ গোরস্তানে তাঁকে সমাহিত করা হয়, যেখানে শুয়ে আছেন বিপুল সংখ্যক সাহাবী আজমাঈন ও তাবেয়িনে কেরাম।