ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথা সমসময়ের একজন প্রধান কথাশিল্পী শওকত আলীর মতে “ আখতারুজ্জামানের রচনা পাঠ সাহিত্যামোদীর কাছে সততই আনন্দময় অভিজ্ঞতা।....... তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের জগৎটির মধ্যেই যে আরও নানান দেখবার ও বুঝবার দিক আছে আমরা তা নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি।..... জীবন ও জগৎকে দেখবার একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আবিষ্কার কবি।” আমাদের বিশ্বাস আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পসমগ্র পাঠের অভিজ্ঞতা পাঠককে বারবার এই উপলদ্ধি ও আবিষ্কারের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।নিজের সম্পর্কে ইলিয়াস বলতেন যে তিনি চব্বিশ ঘণ্টার লেখক।তিনি বেঁচেছেন, পথ চলেছেন, মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এই লেখকের চোখ নিয়ে। জীবনকে তিনি দেখেছেন একজন লেখকের চোখে, তার সমগ্রতায়। উপন্যাসের মতো তাঁর গল্পগুলোতেও যে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশকিত, গভীর জীবনবোধ ও ধারালো হিউমাসের সাক্ষাৎ পাই তাতে সহজেই আমরা তাঁকে একজন বড় মাপের লেখক হিসেবে চিনে নিতে পারি।সাধারণ নিম্নবর্ণের মানুষের মুখের ভাষাও তাঁর লেখায় মর্যাদা পায়, এমনকি স্ল্যাং-ও হয়ে ওঠে আশ্চর্যরকম শিল্পিত। পাঠককে তিনি শুধু গল্প বলেন না, তাকে ভেতর থেকে নাড়া দেন, ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে রাখেন।সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে তাকে ভীষণ অস্বস্তির মধ্যেও ফেলেন। “মানুষের শাণিত স্পৃহা ও দমিত সংকল্পকে আবর্জনার ভেতর থেকে খুঁজে বের করে আনার” যে-দায়িত্বের কথা তিনি বলেছিলেন, কথাসাহিত্যিক হিসেবে আমৃত্যু নিষ্ঠার সঙ্গে নিজেই সে-দায়িত্ব পালন করে গেছেন। উপন্যাসের খোলামেলা চত্ত্বরে ব্যক্তি ও জনগোষ্ঠীকে যেমন তাদের ত্রিকাল জুড়ে দর্শন ও অস্তিত্ববান করা যায়, ছোটগল্পে তেমন সুযোগ কম।ছোটগল্পের আঁট-সাঁট বন্ধনে স্থান, কাল ও ব্যক্তিকে যথাযথভাবে শিল্পায়িত করতে ইলিয়াস যথেষ্ট পরিশ্রম করেছেন। সূচিপত্র *নিরুদ্দেশ যাত্রা *উৎসব *প্রতিশোধ *যোগাযোগ *ফেরারী *অন্য ঘরে অন্য স্বর *খোঁয়াবি *অসুখ-বিসুখ *তারা বিবির মরদ পোলা *পিতৃবিয়োগ *মিলির হাতে স্টেনগান *দুধভাতে উৎপাত *পায়ের নিচে জল *দখল *কীটনাশকের কীর্তি *যুগলবন্দি *অপঘাত *দোজখের ওম *প্রেমের গপ্পো *ফোঁড়া *জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল *কান্না *রেইনকোট
গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মামাবাড়ি। এই মাতুলালয়েই ১৯৪৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পূর্ণনাম আখতারুজ্জামান মুহম্মদ ইলিয়াস হলেও মঞ্জু ডাকনামেও তার পরিচিতি রয়েছে। পৈতৃক বাড়ি ছিলো বগুড়ায়, তাই বগুড়া জিলা স্কুল থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এরপর চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার পর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে, যেখান থেকে তিনি স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। কর্মজীবনে অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আগাগোড়া। জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক পদ থেকে শুরু করে মিউজিক কলেজের উপধ্যাক্ষ, প্রাইমারি শিক্ষাবোর্ডের উপ-পরিচালক পদেও নিয়োজিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন। কবিতার প্রতিও ঝোঁক ছিলো তার, লিখেছিলেন কয়েকটি কবিতা, তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কবিতা কখনো প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তার প্রথম গ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ প্রকাশিত হয়। তার বাচনশৈলী সাধারণ পাঠকদের কাছে প্রথমদিকে বেশ খটমটে লেগেছিলো। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’, যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৮৭ সালে। এছাড়াও আলোড়ন সৃষ্টিকারী তার আরেকটি উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’। আখতারুজ্জামান এর বই সমগ্র-তে মোট দুটি উপন্যাস, পাঁচটি গল্পগ্রন্থ ও একটি প্রবন্ধ সংকলন রয়েছে। ‘খোয়াবনামা’কে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা হলেও আখতারুজ্জামানের ইলিয়াসের ছোটগল্পগুলোও পেয়েছে সমালোচকদের প্রশংসা। তার রচনা বিশ্লেষণধর্মী। পিতা বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন বিধায় রাজনীতিতে তার অংশগ্রহণ ছিলো স্বাভাবিক ঘটনা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর বই সমূহ-তে তাই স্বাদ পাওয়া যায় রাজনীতির, এবং তার লেখার মাধ্যমে সমষ্টি ও ব্যক্তিকে দিয়েছেন সমান মর্যাদা। মুক্তমনা এ লেখক ১৯৮৪ সালে ‘সাহিত্য শিবির’ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস রচনাসমগ্র এবং বাংলা সাহিত্যে বহুমাত্রিক অবদানের জন্য ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ১৯৯৬ সালে আনন্দ পুরস্কার পান। ১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারি এই সৃষ্টিশীল লেখক ইহলোক ত্যাগ করেন।