ভূমিকা একবার এক জ্ঞানী, অভিজ্ঞ কচ্ছপ, কে জানে কেন, এক গোবেচারা খরগোশকে ডেকে বললেন— ‘পৃথিবী বিষয়ে যা জান লিখ।' খরগোশের অবস্থা বর্ণনাতীত। সে শেষমেশ অনেক ভেবেচিন্তে কান- মাথা চুলকে মাটিতে নখ দিয়ে কয়েকটা এবড়ো খেবড়ো আঁচড় কাটল। কচ্ছপ বেশ রেগেমেগেই বললেন——কটা আঁচড় কেটে ছেড়ে দিলে যে বড়? তোমাকে না আমি পৃথিবী বিষয়ে লিখতে বললুম?' খরগোশ তখন কাঁচুমাচু হয়ে বলল—'আজ্ঞে, পৃথিবী বিষয়ে এইটাই আমার বিস্তারিত লেখা, আপনি না মানলে সে আপনার বিবেচনা।' আবৃত্তির চারপাশ বিষয়ে আমার এই এবড়ো খেবড়ো আঁচড়গুলোই, পাঠক, বিস্তারিত লেখা। আপনার বিবেচনা থাকলে মানবেন না। আমি নিজেও মানতে চাইছিলাম না, যখন এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা বইয়ের ভূমিকা লেখার ভার (ভারই বটে!) আমাকে দিয়ে দিলেন ব্রততী'দি, ঠিক যেমন ১৬ বছরের নতুন বউয়ের আঁচলে জমিদার বাড়ির সিন্দুকের চাবিগোছা বেঁধে দেন সম্পন্ন শাশুড়ি-মা আর সে বেচারি উঠতে বসতে চাবি সামলাতেই হিমসিম খায়। সেই অবস্থা এখন আমার। জনৈক তরুণ কবিতাপ্রয়াসী হিসেবে আবৃত্তিশিল্প নিয়ে কতটাই বা কথা বলতে পারি আমি? শুধু মনে আছে সেই সময়টা, কী এক কারণে একটা ক্যাসেট উপহার পেয়েছিলাম, আবৃত্তির। তখনও ‘অ্যালবাম’ মানে ফোটোগ্রাফ সেঁটে রাখার খাতা। তখন সবে সবে পয়সা জমিয়ে কবিতার বই কিনতে শুরু করেছি, এক দুপুরে চালিয়ে শুনলাম ক্যাসেটটা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাই আবৃত্তিকারের গলায় । জলের মতো সহজ, স্বচ্ছ রেখে গোটা কবিতাটা কী চমৎকার পড়ে গেলেন। সেই আমার প্রথম কবিতা ‘শোনা’। কোনও কবির পাঠও শুনিনি তখন অব্দি। এর অনেকদিন পর কোন এক টি.ভি. চ্যানেলে দেখি শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্বয়ং পড়ে শোনাচ্ছেন তাঁর কবিতা আর সেই আবৃত্তিকারের কাছে শোনা কবিতাটাও বাদ নেই। কিন্তু স্বচ্ছতা? সহজতা? কই, তেমন জলের মতো সহজ আর লাগছে না তো সে-ই লেখা? বরং যেভাবে পড়ছেন শক্তি, কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে টানা-টানা সুরে যেভাবে পড়ছেন, অদ্ভূত এক ধাঁধা, এক জটিলতার নকশা তৈরি হচ্ছে যেন। থমকে গেলাম আমি। একই কবিতার এত আলাদা দুটো শ্রুতি হতে পারে? তাহলে সেই আলাদা হবার রহস্য কী? অনেক ভেবে, মাথা খাটিয়ে খরগোশ বুঝতে পারল, টি.ভি. চ্যানেলে হলেও, নিজের জন্যেই কবিতাটা পড়ছিলেন শক্তি। নিজেকেই নিজের লেখা পড়ে শোনাচ্ছিলেন আরেকবার। তাই এই ঘোর, এই জটিলতা। আর ক্যাসেটের সেই আবৃত্তিকার শোনাচ্ছিলেন সবাইকে, সক্কলের জন্যে পড়েছিলেন কবিতা, তাই ওই স্বচ্ছতা । এমনই মনে হয়েছিল আমার, এখনও মনে হয়। আবৃত্তি বিষয়ে এটুকুই জানি। যে মানুষের সঙ্গে কবিতার দৈনন্দিন ওঠাবসা নেই, সারাবছরের আত্মীয়তা নেই, একজন আবৃত্তিকার তাঁর কাছে কবিতাকে নিয়ে যান, একদিনে বন্ধুতা পাতিয়ে দেন। সে মানুষটি তখন রোজ না হলেও, মাসে একদিন কবিতার সঙ্গে দেখা করতে যায়, কাউকে না জানিয়ে। হয়তো এভাবেই তথাকথিত ‘জনতা’র কাছে কবিতাকে পৌঁছে দেয় বাচিকশিল্প, পৌঁছে দেন আবৃত্তিকার। তবে একটা শর্ত থাকে নিশ্চয়ই। একটা কবিতার মেজাজ, মর্জি দাবি মেনেই তো পড়তে হবে তাকে, নিজের খেয়ালখুশি মতো পরে গেলে সে কবিতার কোনও মানে থাকবে না আর। সফল আবৃত্তিকার যাঁরা, নিশ্চয়ই এভাবেই পড়েন কবিতা।