সত্যিই তখন কত কিছুই না আশা করেছিল সন্দীপ। আশা ছিল একদিন বেড়াপোতা স্কুল থেকে বেরিয়ে সে কলকাতার কলেজে পড়তে যাবে। কলেজ থেকে বি.এ. পরীক্ষা দেবে। আর তারপর? আর তারপর সে উকিল হবে। কলকাতার কোর্টে গিয়ে ওকালতি করবে। গরীব মানুষদের উপকার করবে। এখন ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয় যে এত জিনিস থাকতে সে উকিল হতেই বা চেয়েছিল কেন? হয়ত উকিলের পোষাক দেখে। ডাক্তার, ইঞ্জিনীয়ার, প্রফেসার বা অন্য কোন পেশার লোকদের কোনও রকম ধরা-বাঁধা পোষাক-পরিচ্ছদ থাকে না। তবু উকিলদের গায়ে একটা কালো কোট থাকে। বেড়াপোতার চাটুজ্জেবাবুদের ছোটছেলে উকিল হয়েছিল। রোজ রেলস্টেশনে ট্রেন ধরে কলকাতায় যেত ওই কালো কোট পরে। বাড়ি ফিরতো অনেক রাত্রে। সন্দীপ সেই চাটুজ্জেবাবুদের ছেলের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতো । সে কবে ওই রকম কালো কোট পরে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করবে! বেড়াপোতার সমস্ত লোক তার দিকে চেয়ে চেয়ে দেখবে! আশ্চর্য, কত বিচিত্র সব আকাঙ্ক্ষা থাকে মানুষের ছোটবেলায়। সন্দীপ ভাবতে লাগলো মানুষের ছোটবেলাটাই বোধহয় সব চেয়ে সুখের। তখন কত ভালো লাগতো পৃথিবীর মানুষগুলোকে। পৃথিবী মানে তখন সন্দীপ বেড়াপোতাটাকেই বুঝতো। আর কলকাতা? কলকাতার নামটাই শুধু সে শুনে এসেছিল। কলকাতায় যাবার স্বপ্নই দেখতো। কখনও সশরীরে সে যায়নি সেখানে। অথচ বেড়াপোতা থেকে কতই বা দূর। দু ঘণ্টার মধ্যেই ট্রেনে চড়ে পৌঁছানো যেত কলকাতায়। মাত্র বারো আনা পয়সা খরচ করলেই কলকাতায় যাওয়া যেত। কিন্তু সেই বারো আনা পয়সাই বা তখন কে তাকে দেবে?
Bimal Mitra কথাসাহিত্যিক বিমল মিত্রের জন্ম ১৯১২ সালের ১৮ই মার্চ। চেতনা স্কুল ও আশুতোষ কলেজে শিক্ষালাভের পর তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ পাশ করেন ১৯৩৮ সালে । গোড়ায় গান লেখার শখ ছিল । বিখ্যাত গায়করা তাঁর গানে সুর দিয়েছিলেন। পরে তিনি কথাসাহিত্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। প্রথম জীবনে রেল বিভাগে চাকরি করতেন। তারপর সে গল্প-উপন্যাস প্ৰবন্ধ নিয়ে তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা একশতরও অধিক। বাংলা ১৩৭০ সালে তার সরকার রবীন্দ্র-স্মৃতি পুরস্কারে সংবর্ধিত করেন। এই উপন্যাসটি এখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের বৃহত্তম এবং সর্বোচ্চ মূল্যবান উপন্যাস। তবে সাহিত্য পুরস্কার লাভের থেকেও বিমল মিত্র সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বঙ্গভাষার সাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্রের পর তিনিই সর্বভারতীয় সাহিত্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিলেন । তিনি বেগম মেরী বিশ্বাস, সাহেব বিবি গোলাম, কড়ি দিয়ে কিনলাম, একক দশক শতক, পতি পরম গুরু, এই নরদেহ-এপিক উপন্যাসের মাধ্যমে তিনশো বছরের সমাজজীবনের এক বিস্তৃতকালের চালচিত্র বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন । ১৯৯১ সালের ২রা ডিসেম্বর তার তিরোধান হয় ।