এলোঝেলো এলোঝেলো একরকমের পিঠের নাম। তিন বছর আগে জন্মদিনে আমার মেয়ে আমাকে একটি মোবাইল ফোন উপহার দিয়েছিল। সেই থেকে কোনো কোনো সময়ে সঙ্গে থাকে বটে, তবে ব্যবহার খুবই কম করি । এমনিতেই ল্যান্ডলাইন ফোনের কারণেই প্রাণান্তকর অবস্থা। তাই গোদের ওপর বিষফোঁড়া, আমার নিজের মোবাইল ফোনের নাম্বার আমি নিজেই জানি না। উলটোদিকে বড়ো বড়ো করে নাম্বারটি লিখে সেলোটেপ সেঁটে দিয়েছে আমার খিতমদগার। তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ চাইলে ফোনটাকে উলটো করে ধরে নাম্বারটা দেখে নিয়ে তাকে বলতে হয়। তবে আমার ঘনিষ্ঠ জন বেশি নেই। কোনোদিনও ছিল না। সারাটা জীবন, বলতে গেলে, একা একাই কাটালাম ‘এই স্বজনহীন কানন ভূমিতে। সংসারও করেছি, কাজও করেছি অনেকই রকম সতেরো বছর বয়স থেকে কিন্তু আমার ‘কাছের মানুষ' খুব কমই হয়েছে এ জীবনে। চিরদিনই একা ঘরেই কাটিয়েছি একা জীবন, বলতে গেলে। আমার স্ত্রীর এ কারণে আমার বিরুদ্ধে অনেকই ন্যায্য অনুযোগ ও অভিমান ছিল। এবং আজও আছে। তিনি মহিয়সী। অন্য অনেকেরও অভিমান আছে। আমি সকলের কাছেই অপরাধী। আমার লেখালেখি, জীবনী, নানা সৎ ও অকপট সাক্ষাৎকারের কারণেও অনেক মানুষই ক্ষুব্ধ। তাঁদের কাছেও অপরাধী। কেউই ক্ষমা করেনি এই অপরাধীটিকে। একজন লেখকের জীবন অন্য মানুষদের জীবনের মতো হতে পারে না, যদি তিনি যথার্থ লেখক হন। হেমিংওয়ে বলতেন : “A writer is an outlyer, he is like a Gypsy". KAHIL GIBRAN দাম্পত্য সম্বন্ধে যা লিখিছেন 'THE PROPHET”-এ সেটাও সত্যি। একজন যথার্থ লেখক চিরদিনের একা। তাঁর আত্মীয় শুধুমাত্র তার পাঠক-পাঠিকাই, শুধুমাত্র যাদের সঙ্গে তার আত্মার যোগ। একা জীবন কাটাতে হয়েছে আমার জীবনের আশ্চর্য পরস্পর বিরোধী গতি-প্রকৃতির জন্যে। কখনও এই একাকিত্বকে আমি পুরোপুরি উপভোগ করেছি। কখনও ভয়ও করেছি। ভীষণই ভয়, তবে আগল-তোলা ঘরেই জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম। তার জন্যে দুঃখ এবং অপরাধ বোধও হয়তো আছে তবে আনন্দও কম নেই। আমি অন্য দশজনের মতো নই তাই আমার জীবন ও জীবনযাত্রাও অন্যরকম হতে বাধ্য। এই সরল সত্যকে আমি মেনে নিয়েছি।
বুদ্ধদেব গুহ একজন ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সংগীতশিল্পী। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৯ জুন কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। বন, অরণ্য ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখার মাধ্যমে পাঠকহৃদয় জয় করে নেওয়া এই লেখকের জীবন অভিজ্ঞতা ও বৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। রচনাশৈলীর অনন্যতা ও স্বাতন্ত্র্য তাকে বাঙালি পাঠকের অন্যতম প্রিয় লেখকে পরিণত করেছে। বুদ্ধদেব গুহ কবিতা, ছোটগল্প ও উপন্যাস রচনা করেছেন, যা তাকে খ্যাতির চূড়ায় নিয়ে গিয়েছে। তাঁর সৃষ্ট বিখ্যাত চরিত্র ঋজুদা যেন তাঁর মতোই পরিব্রাজক। সে বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায় তার সঙ্গী রুদ্রকে নিয়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে আসা এই লেখক অরণ্যকে যেমন তাঁর লেখার এক মূল আধেয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন, তেমনই তাঁর লেখাগুলোর পটভূমিও ছিল পূর্ব বাংলার গহীন অরণ্য। এর সাথে তিনি সমাজের উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জীবনযাপন তাঁর লেখনীতে তুলে ধরেছেন, যা তাকে খুব সহজেই খ্যাতির পাত্রে পরিণত করে। বুদ্ধদেব গুহ প্রেমের উপন্যাস রচনা করেছেন বেশ কয়েকটি। এর মাঝে ‘হলুদ বসন্ত’ অন্যতম। বাংলা কথাসাহিত্যে এমন রোমান্টিসিজমের সংযোজন খুব কম লেখকই করতে পেরেছেন। পাঠকনন্দিত বুদ্ধদেব গুহ এর উপন্যাস সমগ্র হলো ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘নগ্ন নির্জন’, ‘অববাহিকা’, ‘পরদেশিয়া’, ‘সবিনয় নিবেদন (পত্রোপন্যাস)’, ‘আলোকঝারি’ ইত্যাদি। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ঋজুদা’ সিরিজ। তাঁর রচিত ‘মাধুকরী’ উপন্যাস একইসাথে বিতর্কিত ও তুমুল জনপ্রিয়। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমগ্র শুধু উপন্যাস হিসেবে নয়, নগর ও অরণ্যের স্তুতি হিসেবে পাঠকের কাছে ভালোবাসার স্থান পেয়েছে। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি একজন চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট এবং একজন নামকরা সঙ্গীতশিল্পীও বটে। বুদ্ধদেব গুহ এর বই সমূহ থেকে নির্মিত হয়েছে একাধিক টিভি অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র। ১৯৭৭ সালে তিনি আনন্দ পুরস্কার পান। তাঁর রচনার জন্য তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে এক মাইলফলক তৈরি করেছেন।