ভূমিকা কাজী নজরুল ইসলাম নামটি আমাদের কাছে আগে অত্যন্ত প্রিয় ছিল বিদ্রোহী কবি হিসেবে। কারণ তাঁর কবিতায় আমরা মূলতঃ পেতাম বিদ্রোহের সুর। সে বিদ্রোহ যেমন বৃটিশ সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে, তেমনি সামাজিক অনাচারের বিরুদ্ধে।
বাংলাদেশ সরকার সেই বিদ্রোহী কবিকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করেন। আমাদের সেই বিদ্রোহী কবি এদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে আজ জাতীয় কবি হিসেবে সুপরিচিত।
কবি নজরুলের কবিতা আর সঙ্গীতের সঙ্গে আমরা পরিচিত সেই শৈশব থেকে। ‘লিচুচোর’ বা ‘কাঠবেড়ালী’ কবিতা দুটি নিজে আবৃত্তি করে অথবা অন্যের আবৃত্তি শুনে পরিতৃপ্ত হয় নি- শিক্ষিতদের ভেতর এমন কেউ আছে বলে মনে হয় না। আবার ‘চল্ চল্ চল্’ মার্চ সঙ্গীতের সুরে পা মিলিয়ে কৈশোরে কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছে এমন লোকের সংখ্যাও এদেশে কম নয়। বহু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হতে দেখেছি আমরা সমবেত কণ্ঠে গীত ‘দুর্গম গিরি কান্ডার মরু দুস্তর পারাবার’- সঙ্গীতটির ভেতর দিয়ে। স্কুলের একেবারে নীচের ক্লাশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের পাঠ্যবইতে নজরুলকে পেয়েছি। পুরস্কার বিতরণী বা বিভিন্ন সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে নজরুলের কবিতা ও নাটিকার স্বাদ গ্রহণ করেছি। রবীন্দ্রনাথের মত অত ব্যাপক না হলেও শিশু সাহিত্যে নজরুলের অবদান অপ্রতুল নয়।
অবশ্য একটি কথা বলতে হয় এই প্রসঙ্গে- ছোটদের জন্য রচিত নজরুলের খুব অল্প সংখ্যক কবিতা-ছড়ার সঙ্গেই আমরা পরিচিত। ‘সঞ্চিতা’য় সামান্য কটি শিশুতোষ কবিতার সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু আসলে ছোটদের জন্য তাঁর লেখার সংখ্যা যথেষ্ট। তাঁর অনেক কবিতা-ছড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে- যা সংগ্রহ করে পুস্ককাকারে প্রকাশের উদ্যোগ তেমন একটা চোখে পড়ে ন।
সুবর্ণ প্রকাশনী এই কাজটিতে হাত দিয়ে আমাদের একটি বড় অভাব পূরণ করলেন। শিশু-কিশোরদের উপযোগী অনেক রচনার সন্নিবেশে তাঁরা নজরুলের ‘নির্বাচিত কিশোর সাহিত্য’ বইটি প্রকাশ করেছেন। এর অনেক কবিতার সঙ্গে আমি নিজেও পরিচিত ছিলাম না। নজরুলের শিশু সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য এ ধরনের একটি বই যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে আমার ধারণা। প্রকাশকের এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই।
রোকনুজ্জামান খান ১৭-২-৯৩
সূচিপত্র * ঝিঙেফুল * পুতুলের বিয়ে * সঞ্চয়ন * ঘুম জাগানো পাখী * কিশোর * হাসির কবিতা * নাটিকা * গল্প * আরো কবিতা * নজরুল জীবনী
১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, গীতিনাট্যকার, অভিনয়শিল্পী, সুরকার ও প্রবন্ধকার। নজরুলের বাল্যকাল কেটেছে দুঃখ-দুর্দশায়। তাই তাঁর ডাকনাম ছিলো দুখু মিয়া। তাঁর বৈচিত্র্যময় শিক্ষাজীবন শুরু হয় গ্রামের মক্তবে। পিতৃহীন হওয়ার পর তিনি পড়ালেখা ছেড়ে যোগ দেন লেটোর দলে, যেখান থেকে তিনি কবিতা ও গান রচনার কৌশল রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এক বছর ময়মনসিংহের দরিরামপুর হাই স্কুলে পড়ে পুনরায় চুরুলিয়ায় রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ স্কুলে ভর্তি হন, এবং সেখানে তিন বছর অধ্যয়ন করেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই তাকে পড়ালেখা ছাড়তে হয় যুদ্ধে যোগদানের জন্য। যুদ্ধের দিনগুলোতে নানা জায়গায় অবস্থান করলেও তার করাচির সৈনিকজীবনই উল্লেখযোগ্য, কেননা সেসময়েই তার প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় ‘বাউণ্ডেলের আত্মকাহিনী’ নামক গল্প প্রকাশের মাধ্যমে। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমূহ’র বিষয়বস্তু বিবিধ। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এর বই-এ সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণা এবং সাম্যবাদের ধারণা প্রকটভাবে স্থান করে নিয়েছে। রাবীন্দ্রিক যুগে তার সাহিত্য প্রতিভা উন্মোচিত হলেও তার সৃষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাজী নজরুল ইসলাম এর বই সমগ্র এর মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো ‘রিক্তের বেদন’, ‘দোলনচাঁপা’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘প্রলয়শিখা’ ইত্যাদি। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী নজরুল ‘সাপ্তাহিক লাঙল’, দ্বিসাপ্তাহিক পত্রিকা ‘ধূমকেতু’র সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি এবং বাংলা সাহিত্যের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।