“প্রবন্ধসমগ্র ২য় খণ্ড" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ মনীষী-লেখক আমরা তাদেরকেই বলি যাঁদের রচনায় একই সঙ্গে যুগ ও যুগান্তরের স্বপ্ন-সাধনা মূর্ত হয়ে ওঠে। প্রয়াত আহমদ ছফা আমাদের দেশের সেরকম মানসিকতাসম্পন্ন লেখক ছিলেন। রচনাশৈলির সঙ্গে মনীষার এমন সম্মিলন। কখনাে কখনাে ঘটে, সব লেখকের লেখায় যা ঘটে না। সাহিত্যিক পরিচয়ের উর্ধ্বে আমাদের কালের এক চিন্তানায়কের মর্যাদায় তাঁকে অধিষ্ঠিত করেছে তার প্রজ্ঞা, মননশীলতা, অন্তদৃষ্টি, ইতিহাসবােধ, ঐতিহ্য-সচেতনতা, মানবপ্রীতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা। তাঁর অনুপস্থিতি আমাদের মধ্যে এই বােধকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। তাঁর জীবদ্দশায় যারা হয়তাে অনেক বিষয়ে তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করতেন এমনকি তাদের পক্ষেও তাঁর চিন্তার প্রাতিস্বিকতা ও প্রতিভার মৌলিকতুকে অস্বীকার করার উপায় ছিল না। একথা বলা যায় যে, বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে তাঁর রচনার শরণাপন্ন হতে হবে। সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও আহমদ ছফা তাঁর অতুলনীয় দক্ষতার পরিচয় দিলেও, তাঁর মনীষার শ্রেষ্ঠ ফসল বােধ করি তাঁর প্রবন্ধগুলি। গুণী সাহিত্য সমালােচকরা যাকে আমাদের গত অর্ধ-শতাব্দীর চিন্তাচর্চার সেরা প্রসূন বলে উল্লেখ করেছেন।
বাঙালি মুসলিম লেখকদের মধ্যে অন্যতম কীর্তিমান কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা একাধারে ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, গণবুদ্ধিজীবী ও চিন্তাবিদ। বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া গ্রামে। নিজ এলাকায় তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয়, এবং ১৯৫৭ সালে তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন এবং মাস্টারদা সূর্যসেনের আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হলেও সেখানে পড়ালেখা শেষ করেননি, এবং জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অধীনে পিএইচডি শুরু করলেও তা আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি। আহমদ ছফা এর বই সমূহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পাঠকদের মধ্যে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বই হিসেবে প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। আহমদ ছফা এর বই সমূহের মাঝে 'ওঙ্কার', 'অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী', 'বাঙালি মুসলমানের মন', যদ্যপি আমার গুরু', 'গাভী বিত্তান্ত' প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তাঁর আরেকটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি হলো জার্মান সাহিত্যিক গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম 'ফাউস্ট' বাংলায় অনুবাদ করা। আহমদ ছফা এর বই সমগ্র একত্রিত করে রচনাবলি আকারে ৯টি খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী এই সাহিত্যিক 'লেখক শিবির পুরস্কার' ও বাংলা একাডেমির ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ পেলেও সেগুলো গ্রহণ করেননি। এই পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক ২০০১ সালের ২৮ জুলাই ৫৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত হন।