পোল্যান্ডের বিখ্যাত সাংবাদিক রিজার্ড কাপুচেনস্কি পেশাগত কারণে বিশ্বময় ঘুরে বেড়িয়েছেন। বিস্তর দেখেছেন, শুনেছেন আর ঘটনার অন্তরালের ঘটনাকে জানবার অদম্য ইচ্ছা বরাবরই ভিন্নতা এনে দিয়েছে তাঁর লেখাতে৷ কখনোই ফিকশন লিখেন নি। তবুও সাহিত্যে নোবেলের জন্য মনোনীত হয়েছেন৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভাগ্যের শিকে ছেঁড়েনি৷
" Shah Of Shah" বইটি ১৯৭৯ সালের ইরানের বিপ্লবের পটভূমিতে লেখা। সেই বিপ্লবের কারণ, পাহলভি বংশের নামধারণকারী রেজা খানের উত্থান এবং একজন স্বেচ্ছাচারী শাসকের ক্ষমতার উত্তাপ কীভাবে অঙ্গার করে দিতে পারে জনগণকে তা খুব ভালো করেই বিবৃত করেছেন কাপুচেনস্কি। আর রাষ্ট্রীয় বিপ্লব কিংবা শাসকগোষ্ঠীর পতন যে শোষিত জনতা নয়; বরং শাসক নিজের ভুলে নিজেই ঢেকে আনে - এই ঐতিহাসিক সত্যকে আরো একবার প্রামাণ্য হিসেবে উপস্থাপন করলেন সাংবাদিক কাপুচেনস্কি৷
স্বৈরাচার শাসক রেজা শাহ পাহলভির পতনের ইতিহাসের সাথে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠীর মনোভাবের অসম্ভব সাদৃশ্য রয়েছে। কাপুচেনস্কি ইরানে এসেছেন৷ততদিনে ইরানে বিপ্লব হয়ে গিয়েছে৷ তিনি বিপ্লবোত্তর ইরানের ঘটনার সমান্তরালে না হলেও কিছুটা একইসাথে শোনাচ্ছেন। যখন পৌছালেন ইরানে দেখলেন,
" Everything is in confusion, as though the Police have just finished a violent, nervous search. Newspapers, local and Foreign, are scattered everywhere, special editons, big attention getting headlines, HE HAS LEFT "
কাপুচেনস্কি লক্ষ করলেন এই থমথমে অবস্থাতেও ইরানবাসী সর্তক। কেননা তাদের তখনো ধারণা,
" He will make deceive you and make promises to you, but don't let yourself be fooled. "
যেন সবাই পালিয়ে যাওয়া শাসক রেজা শাহ পাহলভির ফাঁদ নিয়ে শঙ্কিত। কেউই বিশ্বাস করতে চাইছেনা একদা ইরানবাসীর ভাগ্যবিধাতা রেজা শাহকে। এদিকে বিপ্লবোত্তর পারস্যেও ঘুমোট ভাব।সারা শহর জুড়েই বিশৃঙ্খলা। বিদেশিরাও ভীত। স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য ধুঁকতে শুরু করেছে৷ পর্যটক নেই। তাই যেসব হোটেল রাজার আমলে বিদেশিদের ভীড়ে জনাকীর্ণ থাকতো।তখন সেখানে মাছি উড়ছিল। আর মাছি-মারা কেরানির কাজ করছিল বিপ্লবীরা৷
খোমেইনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। কাপুচেনস্কি দেখলেন, খোমেইনি লোকটি রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও কত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত।দেশের সর্বোচ্চ নেতা খোমেইনি রাজধানীতে জাঁকিয়ে বসলেন না৷ বরং তিনি রাজধানীর বাইরে কওম( Qom) শহর থেকে নিয়ন্ত্রন করতেন দেশকে। অনেকটা ভারতের স্বাধীনতার পর গান্ধি যেমনটি করেছিল৷ মুক্তিযুদ্ধের পর অবশ্য বঙ্গবন্ধুকেও এভাবেই রাজধানীর বাইরে থেকে জাতির পিতা হিসেবে রাষ্ট্রকে গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন সিরাজুল আলম খানরা৷সে অন্য প্রসঙ্গ। খোমেইনির কওম শহরের ছোট্ট ঘরটিই ছিল রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কার্যালয়। আর খোমেইনি কারও সাথে দেখা করতেন না৷ ইরানের পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে যেমনটি খোমেইনি বলেছিলেন তা অনেকটা এখনও অপরিবর্তিত,
"..nobody will tell us what to do in our own home or impose anything on us" খোমেইনির "nobody"
যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তারমানে বিপ্লবোত্তর ইরানের সাথে শাহপন্থী ইউএসের শত্রুতা গোড়া থেকেই৷
কাপুচেনস্কির লেখার একটি চমৎকার দিক হলঃ তিনি শুধু ইরানের মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি৷ যুগধর্ম যে বদলে গেছে তারও আভাস দিয়েছেন বেশ সহজবোধ্যভাবে।
এদিকে বিপ্লবের পর সাবেক শাসকপন্থীদের গর্দান নিয়ে নেওয়ার চিরন্তন রীতি চালু হয়ে গেছে। আরেকদিকে, প্রতিবিপ্লবীসহ অন্যান্য মিলিশিয়া গোষ্ঠীও নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। এই বিশৃঙ্খলার বর্ণনা দেননি কাপুচেনস্কি। অথচ বাক্যের গভীরতার কারণে সহজেই বোঝা যায় কি ঘটছিল সেখানে।
বিপ্লবী ইরান থেকে লেখক ফিরে গেলেন রাজতন্ত্রী ইরানে। ইতিহাস হাতড়ে বের করলেন রেজা শাহের পূর্বপুরুষের উত্থানের ইতিবৃত্ত। রেজা শাহ পাহলভির পিতার নামও ছিল রেজা খান৷ এই ব্যক্তি সাবেক রাজাদের সেনাবাহিনীতে কর্মকর্তা ছিলেন।ইরান তখনও ইরান হয়নি৷ পারস্য নামেই পরিচিত। পারস্য তখন রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে৷ জারশাসিত রাশিয়ার সেনাকর্তা লিয়াকভের নেতৃত্বে চলে পারস্য সেনাবাহিনী৷ এই লিয়াকভের খুব কাছের মানুষ রেজা খান। ১৯১৭ সালে গণেশ উল্টে গেল। রুশ বিপ্লবে জার শাসনের পতন ঘটল৷ পারস্যধিপতি লিয়াকভকে বলশেভিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল মনে করলেন। ঠিক তখনই ভাগ্যচাকা চলে গেল সামান্য সেনাকর্তা রেজা খানের পক্ষে৷ লিয়াকভের বদলে পারস্যরাজের বিশ্বস্ত হয়ে উঠলেন রেজা খান। ১৯১৭ সালের পর পারস্য চলে গেল ব্রিটিশ প্রভাববলয়ে। ব্রিটেন নিজেদের লোক রেজা খানকে বসিয়ে দিল ক্ষমতায়। এটি ১৯২১ সালের ঘটনা৷ ব্রিটিশ জেনারেল এডমন্ডের সক্রিয় সৈন্য সহায়তায় রেজা খান তেহরানে প্রবেশ করলেন৷ বন্দি হল সকল রাজনীতিবিদ।