"শ্রেষ্ঠ উপন্যাস" বইয়ের ফ্ল্যাপের লেখা: শরশ্চন্দ্রের জন্ম হয়েছিল উনিশ শতকের নবজাগরণের শেষপর্যায়ে। পাশ্চাত্য রেনেসাঁসের সঙ্গে ভারতীয় নবজাগরণের পার্থক্য সুবিদিত। এই নবজাগরণের মূলে ছিল ধর্মীয় ও সমাজসংস্কারের আন্দোলন এবং কিছু রাজনৈতিক সুবিধা আদায়।। শরশ্চন্দ্রের সময়ে এই আন্দোলন ক্রমশ রাজনীতিপ্রধান হয়ে ওঠে। তার জন্মের পূর্বেই বুর্জোয়াদের অভ্যুদয় ঘটে। ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লবের ঢেউ এদেশেও এসে পৌঁছে। শরৎচন্দ্রের সাহিত্যে সে ঢেউ আরাে প্রবল। শরশ্চন্দ্রের সাহিত্যে সমাজসমস্যার কোনাে উত্তরণের চিত্র নেই বলে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সে সম্পর্কে শরৎচন্দ্র বলেছেন, তিনি সাহিত্যে দুঃখের বিবরণ দিয়েছেন, সমস্যার বিশ্লেষণও করেছেন কিন্তু সমাধানের কাজ সমাজ-কর্মীর। শরশ্চন্দ্রের রচনার প্রেরণা তার সময় ও সমাজ। তিনি যে গভীর ও তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সমাজসভ্যতাকে দেখেছেন তার রচনায় তা আরাে স্বচ্ছ ও কালােত্তীর্ণ করে তুলেছেন। সমাজ শ্রেণীবিভক্ত। এক শ্রেণী প্রবল, ধনবান। তারা মুখে ধর্মের কথা বললেও এদের কোনাে ধর্মজ্ঞান নেই। আর এক শ্রেণী দুর্বল, অসহায়। প্রবলের অত্যাচার থেকে দুর্বলের বাঁচবার কোনাে পথ নেই। শরৎচন্দ্রের কথায়, “কোথাও ইহার নালিশ চলে না, ইহার বিচার করিবার কেউ নাই— ভগবান কান দেন না, সংসারে চিরদিন ইহা অবারিত চলিয়া আসিতেছে।” সাধারণ চলতি কথায় এই দুটোর পরিচয় দেয়া হয় দ্রলােক এবং ছােটলােক বলে। ভদ্রলােক যা করে তাই সত্যি। কারণ সমাজের শাসন তাদের হাতে। ধর্ম, আইন আদালতও তাদেরই পক্ষে। শরশ্চন্দ্র একাধিকবার বলেছেন- সাহিত্যে তিনি গুরুবাদ মানেন এবং তিনি রবীন্দ্রনাথের শিষ্যত্ব স্বীকার করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি চোখের বালি’, ‘গােরা’, ‘যােগাযােগ’ ইত্যাদি উপন্যাসের উল্লেখ করেছেন। একদিন সমাজের অনাচার, কুসংস্কার, অকাল বৈধব্যের সুদীর্ঘ অনুশাসন, অন্যদিকে নরনারীর অবারিত অপ্রতিরােধ্য প্রেম, প্রেমের জন্যে সমাজ সংসার তুচ্ছ করে কাক্ষিতকে কেন্দ্র করে জীবনের বলিদান-এই—দুই-ই তার লেখায় মর্মস্পর্শী।
বাঙালির জীবনের আনন্দ-বেদনাকে সাবলীল স্বচ্ছন্দ ভাষায় যে কথাশিল্পী পরম সহানুভূতি ভরে তুলে ধরেছেন বাংলা সাহিত্যে, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, হুগলি জেলার ছোট্ট গ্রাম দেবানন্দপুরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন শরৎচন্দ্র। দারিদ্র্যের কারণে তাঁর শৈশবকাল বলতে গেলে মাতুলালয় ভাগলপুরেই কেটেছে। দারিদ্র্যের কারণে ফি দিতে না পেরে বেশ কয়েকবার স্কুল বদলিও করতে হয়েছিলো ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ও মেধাবী শরৎচন্দ্রের। এন্ট্রান্স পাস করে কলেজে ভর্তি হলেও এফএ পরীক্ষার ফি জোগাড় করতে না পেরে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। দারিদ্র্য যখন শিক্ষাজীবনে অব্যহতি টানলো, তারপরই শুরু হলো আপাত সাধারণ এই মানুষটির বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যজীবন। এ সময় প্রতিবেশী বিভূতিভূষণ ভট্টের বাড়িতে আয়োজিত সাহিত্যসভায় লেখালেখির অনুপ্রেরণা ফিরে পেলেন যেন আবার। যার ফলশ্রুতিতে বাংলা সাহিত্য পেয়েছিলো বড়দিদি, দেবদাস, চন্দ্রনাথ, শুভদা’র মতো কালোত্তীর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাস সমগ্র। কাছাকাছি সময়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প অনুপমার প্রেম, আলো ও ছায়া, হরিচরণ, বোঝা ইত্যাদি রচিত হয়। বনেলী রাজ স্টেটে সেটলমেন্ট অফিসারের সহকারী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন এসময়। কিন্তু তারপরই বাবার উপর অভিমান করে সন্ন্যাসদলে যোগ দিয়ে গান ও নাটকে অভিনয়ে মনোনিবেশ করেন। কখনও কলকাতা হাইকোর্টের অনুবাদক, আবার বার্মা রেলওয়ের হিসাব দপ্তরের কেরানি হিসেবেও কাজ করেন শরৎচন্দ্র। রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন ১৯২১ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে, এবং হাওড়া জেলা কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে। এর মাঝে নিরন্তর চলেছে নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতা উৎসারিত সাহিত্যচর্চা। সমষ্টি আকারে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গল্প সমগ্র বিন্দুর ছেলে ও অন্যান্য, শ্রীকান্ত-৪ খন্ড, কাশীনাথ, ছেলেবেলার গল্প ইত্যাদি সময় নিয়ে প্রকাশিত হলেও পেয়েছিলো দারুণ পাঠকপ্রিয়তা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমূহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে, এবং বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে হয়েছে সমাদৃত। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর বই সমগ্র দেবদাস, শ্রীকান্ত, রামের সুমতি, দেনা-পাওনা, বিরাজবৌ ইত্যাদি থেকে বাংলাসহ ভারতীয় নানা ভাষায় নির্মিত হয়েছে অসাধারণ সফল সব চিত্রনাট্য ও চলচ্চিত্র। সাহিত্যকর্মে অসাধারণ অবদানের জন্য এই খ্যাতিমান বাংলা সাহিত্যিক কুন্তলীন পুরস্কার, জগত্তারিণী স্বর্ণপদক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিলিট উপাধি লাভ করেন। ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।