"বেহুঁশের চৈতন্য দান" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ‘আল হাকু মুররুন' মানে সত্য বড় তিতা বা কড়া, ইহা কোরানের কথা। জ্ঞানে হয় জ্ঞানী, অজ্ঞানে হায়ানী, হুঁশে মানুষ, ইনসাফে ইনছান ; ইহাই কোরানের বিধান। তবে ঔষধ তিক্ত হলেও রােগীর জন্য মঙ্গলজনক। সত্য কথা বলার উপদেশ সবাই দেয়, কিন্তু ফস্ করে বলে ফেললেই মামাজী বেজার। যুগে যুগে সত্যের উপর মিথ্যার হিমালয় রচিত হয়েছে কট্টর মৌলবাদী মােল্লা মৌলবীদের দ্বারা এবং এক শ্রেণীর ক্ষমতাসীনদের দ্বারা, তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য। যদিও সত্য কখনাে ফাঁকে ফোঁকে শ্বাস ফেলার চেষ্টা করে অমনি শুরু হয় হট্টগােল বাধিয়ে গলা চেপে ধরার প্রতিযােগিতা। যুগে যুগে মহাপুরুষগণ মিথ্যা সারবিহীন শুধু আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্ম হতে, অজ্ঞানতার গোঁড়ামী হতে, সামাজিক অন্ধ কুসংস্কার ও কলুষতা হতে মানুষকে উদ্ধার করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বার্থ লােভী ও তথাকথিত অজ্ঞানী অন্ধ অনুসরণকারীদের পক্ষ হতে বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়েছে। এরা কখনাে ফতােয়া দিয়েছে কাফের ফাসেক ইত্যাদি বলে, কারাে নামে মিথ্যা অপবাদ রটিয়েছে কখনাে দেশ ছাড়া করেছে, বাড়ী ঘর পুড়িয়েছে, হত্যা করেছে। তাদের তথাকথিত ধর্ম গেল ধর্ম গেল বলে রাস্তায় চিৎকার করেছে। ধর্মের মূল উদ্দেশ্য আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মজ্ঞান লাভ করে স্রষ্টার নৈকট্য লাভ করা। কেবল মুষ্টিমেয় কয়জন চিন্তাশীল ব্যক্তি ছাড়া অধিকাংশই ধর্মের শুধু বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানসর্বস্ব বক ধার্মিকতা প্রদর্শন করছে এবং তাদের সংখ্যাই বেশী বিধায় সমাজ এবং সামাজিকতা ধর্ম হতে দূরে সরে যাচ্ছে, রাছুলের ভাষায় ওরা হবে বাহাত্ত্বর কাতার। ক্রমে মানব সমাজ ও মানবতা ধ্বংশের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে। যখনই কেহ আচার অনুষ্ঠানের উপর আত্ম পরিশুদ্ধি ও আত্মজ্ঞানের প্রাধান্যের কথা বলতে যায় তখনই তার বিরুদ্ধে তথাকথিত জ্ঞানান্ধ কট্টর মৌলবাদীগণ প্রতিরােধ বা দল সৃষ্টি করতে থাকে এবং ছুঁড়ে মারা হয় এক বস্তা ফতােয়া, যেমন দিত ইয়াজিদ ও তার পােষা আলেম-মােল্লাগণ। এর মানে ওরা কাউকে মানুষ হতে দিবে না। আসলে তারাই জালেম যারা নিছক আচার অনুষ্ঠানকে ধর্ম বলে জানে এবং মানে, সে মতে প্রচার করে যার ভিত্তি অন্ধ অনুমান। তাদের দ্বারাই ঘটে ধর্মের নামে নির্লজ্জ অঘটন, প্রতিহিংসার প্রতিযােগিতা, ইতিহাস তার সাক্ষী। প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই ধর্মের ছদ্মাবরণে এ সমস্ত মৌলবাদীগণ অবস্থান করছে। কোরান বলছে- “জ্ঞানবানরাই আমার উপদেশ গ্রহণ করে। এ জ্ঞান আত্মদর্শনের জ্ঞান। অজ্ঞানে এবাদত হয় না তথা মুক্তি নেই এবং এরাই পথভ্রষ্ট। অনুমানে খােদা বিশ্বাসও এক প্রকার শেরেকী। শুধূ আনুষ্ঠানিক নামাজ, রােজা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদিই ইসলাম নয়, ইহা কোরানের পরিপন্থী। এগুলাে ধর্মের ছামান পত্র তথা সাজ। এদিকটি সমাজের একতার দিক। সাজে কাজ হবে না তথা মর্মবিহীন কর্ম বা আত্মশুদ্ধি ও আত্মজ্ঞান ব্যতীত ‘ওয়াইল দোযখে ঠিকানা হবে কোরান তার সাক্ষী দিচ্ছে। নিজেকে চেনা-জানা-ই এবাদত এবং তার উদ্দেশ্য। কোরানে বলছেঃ “ইন্নালল্লাযীনা আ-মানু ওয়া আমিলুচ্ছা-লিহাতি উলা ইকাহুম খাইরুল বারিইয়্যাহ” অর্থাৎ নিশ্চয় যারা আমানু এবং করে সকর্ম তথা নফস শুদ্ধির কর্ম তারাই সৃষ্টির উত্তম (সুরা বাইয়্যিনাহ- ৭ আয়াত)।br সূরা শামছের ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে, b“কৃাদ আফলাহা মান যাক্কা-হ” অর্থাৎ নিশ্চয়ই সে সফলকাম হয়েছে যে ইহাকে (কৃলবকে, নফসকে, অন্তকরণকে) বিশুদ্ধ করেছে। ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, b“ওয়া কৃাদ খা-বা মান দাসসা-হা” অর্থাৎ এবং নিশ্চয়ই সে ব্যর্থ হয়েছে যে ইহাকে (স্বীয় নফসকে) কলুষিত করেছে তথা বস্তুমােহে বা হায়ানী আত্মার গুণ-খাছিয়তে আবৃত করেছে। সুতরাং পূর্বের উত্তম স্বভাব ফিরে পাওয়া তথা তাতে পৌঁছার পদ্ধতি তথা মানবাত্মা রক্ষা করাই ইবাদত (সুরা আরাফ২৯ আয়াত)। মানবাত্মার হেফাজত করতে বলা হয়েছে কোরানে এবং মানবাত্মাধারী মানুষই স্বয়ং ছালাত। কাজেই নিজেকে চেনা-জানাই যে এবাদত এ কথা তথাকথিত নির্বোধগণের বােধগম্য হচ্ছে না, বুঝতে চায় না এবং অন্যকেও বুঝতে দেয় না। এক শ্রেণির জালেম, আলেমের বেশ ধরে নায়েবে রাছুল (যদিও নায়েবে রাছুল কথাটি সঠিক নয়) সেজে ইয়াজিদের মতবাদ তথা শুধু অনুষ্ঠানসর্বস্ব ধর্মকে মােহাম্মদী ইসলাম বলে অদ্যাবধি সমাজে চালাচ্ছে। তাদের দল সমাজে অনেক বেশী, যেমন ছিল কারবালায় ধর্মের হিজাব পড়া ইয়াজিদপন্থী মুনাফিকের দল এবং হুসাইন আলাইহিস্ সালামপন্থী তথা দ্বীনে মােহাম্মদীর অনুসারী মুসলমান। কারবালায় ইয়াজিদের লােকসংখ্যা ত্রিশ হাজার। এরা সবাই কালেমা, নামাজ, রােজা, হজ্জ ও যাকাত পালন করতাে, ইমামতি করতাে, খুত্বাহ দিতাে। ঐ ত্রিশ হাজার ইয়াজিদের সৈন্যদের মধ্যে আড়াই শত কোরানে হাফেজ ছিল, তাফসীরকারকও ছিল। অপর পক্ষে হুসাইন আলাইহিস সালামের পক্ষে ছিল বাহাত্ত্বর জন। অথচ ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম তাদেরকে মুসলমান বলেই স্বীকার করলেন না। তিনি তাদেরকে প্রশ্ন করলেন, “আলাইছা ফি মুসলিমুন ?” অর্থাৎ তােমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই ? সেনাপতি হুর তার ভাই, গােলামসহ ত্রিশ জন অনুচর নিয়ে ইমাম হুসাইন আলাইহিস্ সালামের পক্ষে এসে যােগদান করলেন। এখানেই আসল ও নকল মুসলমানের পরিচয় করিয়ে দিলেন ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম। ইমাম হুসাইন আলাইহিস সালাম শহীদ হবার পর ইয়াজিদ এবং তার সহযােগীরা ইসলামের মূল শিক্ষা বর্জন করে তাদের মতবাদ, তাদের স্বার্থের আনুকূল্যে ব্যবহার এবং প্রচার করেছিল, প্রয়ােজনে হাদিস তৈরী করতাে, ফতােয়া দিতাে তার স্বার্থ ও তার প্রচারিত মতবাদের পক্ষে। ঐ শিক্ষাই অদ্যাবধি আলেম-মােল্লাগণ শিক্ষা দিচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ গ্রহণ করছে। কারণ ইয়াজিদ ও তার সতীর্থরা মৃত্যুর করাল গ্রাসে পতিত হলেও তাদের প্রেতাত্মাগুলাে শত সহস্র-লক্ষ ভাগে বিস্তার লাভ করে আছে মুসলিম সমাজে। শুধু বাহ্যিক আচারনিষ্ঠ নামাজ, রােজা, হজ্জ, যাকাত ও কালেমা ইত্যাদিই ইসলাম- এ কথা ইয়াজিদ ও তার সতীর্থগণ প্রচার করেছে।