"তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১৯৫২-৪র্থ খণ্ড" বইটির লেখকের কথা থেকে নেয়াঃ তাজউদ্দীন আহমদ '৭১-এর মুক্তিসংগ্রামের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব; প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী; মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিচালনার পর অসাধারণ কর্মদক্ষতা ও বিচক্ষণতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামাে বিনির্মাণে। এই গ্রন্থে ঐতিহাসিক ১৯৫২ সনের ১লা জানুয়ারি থেকে ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়পরিসরে সাহসী ও অমায়িক এই মহৎ পুরুষের তরুণ বয়সের চিত্তাকর্ষক বিভিন্ন ঘটনাবলি প্রতিফলিত হয়েছে। দেশ ও সমাজের প্রতি অতুলনীয় নিষ্ঠা ও দায়িত্ববােধ প্রতিভাত হয়েছে সুলিখিত তাঁর দিনলিপিতে। অত্যন্ত সুনিপুণ ও সুশৃঙ্খল জীবন প্রণালীর প্রতিটি ক্ষণেই এই কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব নিজেকে নিবিষ্ট রেখেছেন মানবিক, সামাজিক, আতিথেয়তা ও চিত্তবিনােদনমূলক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। মাতৃভাষার জন্য প্রতিবাদী আন্দোলন, যুগােপযােগী শিক্ষানীতি, উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা, স্থানীয় জনগণের দুর্ভোগ নিরসনে গণসংযােগ এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা যুদ্ধে গঠনমূলক নেতৃত্বের পূর্বাভাস এই দিনপঞ্জিকায় প্রকাশ পেয়েছে। '৫২-র ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অশান্ত পরিস্থিতি ও পুলিশের অপতৎপরতার প্রেক্ষাপটে ফজলুল হক ও সলিমুল্লাহ মুসলিম ছাত্রাবাসের অ্যাসেমব্লি হলে ছাত্র সমাবেশে তাজউদ্দীনের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর তাঁর সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞারই পরিচায়ক। সমাজসেবা আর ছাত্র রাজনীতির শত কর্মব্যস্ততা জ্ঞান-পিপাসু তাজউদ্দীনকে গ্রন্থাগারে জ্ঞানসাধনা ও শ্রেণী কক্ষে পাঠদান থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি শ্রীপুর হাইস্কুলে '৫২ সনের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন। অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরন্তর থেকেছেন আপসহীন; চেকের বিপরীতে ব্যাংক কর্মকর্তা প্রদত্ত অতিরিক্ত টাকা পরবর্তীতে ফেরত দিয়ে চারিত্রিক সততার নিদর্শন রেখেছেন। অনুপম মানবিক গুণাবলির অধিকারী তাজউদ্দীন নবীন বয়সেই জনকল্যাণমূলক কাজে আত্মনিয়ােগ করেছিলেন। অসহায়, হতদরিদ্র ও পীড়িত মানুষের পাশে থেকেছেন সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে; কিনে দিয়েছেন ঔষধপত্রাদি। ধর্মের প্রতি অনুরাগ তাঁকে নিয়মিত জুমার নামাজ আদায়ে সচেষ্ট রেখেছে। নিয়ত জনসংযােগে ব্যস্ত থেকেছেন বিভিন্ন সভা-সমিতিতে। তার দৈনন্দিন চলাফেরা শুধু ঢাকা শহরে কামরুদ্দীন আহমদ, আতাউর রহমান খান, এফ করিম, তােয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখের বাসাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রায়শই নাড়ির টানে ছুটে গিয়েছেন ঢাকা থেকে ৮২ কিলােমিটার দূরের নিজ গ্রাম কাপাসিয়ার দরদরিয়ায়; সমাধান করেছেন গ্রামের সাধারণ মানুষের পারিবারিক সমস্যা। অর্থনীতির চিন্তাশীল এই মেধাবী ছাত্র প্রতিনিয়ত প্রখর দৃষ্টি রেখেছেন সমসাময়িক বিশ্বপ্রেক্ষাপট ও অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর; লিপিবদ্ধ করেছেন ধান, পাটের বাজার দর, পাট চাষীদের দুরবস্থা আর কৃষি উৎপাদনের গতিধারা। অল্প বয়সেই তার এই সমাজ সচেতনতা, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, চারিত্রিক সততা ও দৃঢ়তা তাঁকে পরবর্তীতে একজন পরিশীলিত রাজনীতিবিদের আসনে সমাসীন করেছিল। আত্মশক্তিতে বলীয়ান তরুণ তাজউদ্দীনের মধ্যে সুপ্ত ছিল ভাষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, সর্বোপরি '৭১-এর মুক্তিসংগ্রামের নেতৃত্ব, যা তাঁর দিনপঞ্জিকার সুবিন্যস্ত ও সময়নিষ্ঠ ধারা বর্ণনায় প্রকাশ পেয়েছে। তাজউদ্দীনের ডায়েরি এ দেশের ইতিহাসে এক অমূল্য সম্পদ; তরুণ সমাজের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত, যা তাদেরকে সােনালি বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ও দেশমাতৃকার সেবায় নিজেদের উৎসর্গ করতে অনুপ্রাণিত করবে। আমার বড়ই সৌভাগ্য হয়েছিল এই ডায়েরিগুলাে দেখার এবং সেগুলাে ব্যবহার করার। তাঁকে নিয়ে আমার লেখালেখি ও গবেষণার অনুপ্রেরণাও আমি এসব ডায়েরি থেকেই প্রথমে পেয়েছিলাম। খুশি হয়েছি যে, তার যােগ্য কন্যা সিমিন হেসেন রিমি ইংরেজিতে লেখা এই ডায়েরিগুলাের বাংলা অনুবাদ প্রকাশে এগিয়ে এসেছে। নির্ভীক এই বীর বাঙালি হয়তাে ধারণা করেননি ইতিহাসের নির্মম এক কালাে রাতে তাঁকে বলী হতে হবে, রয়ে যাবে শুধু তাঁর স্মৃতিকথা।