রবীন্দ্রবাবুর জীবনে এবং কাব্যে এত বিচিত্র ভাবের সমাবেশ আছে যে তাহার নানান মহল্লায় প্রবেশদ্বারের চাবি সকল সময়ে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। আমাদের দেশে জন্মগ্রহণ করিয়া বিচিত্রতার স্বাদের জন্য কবির চিত্তে এমন সুগভীর আকাঙ্ক্ষা কি করিয়া জাগিল, তাহা আমার কাছে বিস্ময়কর। আমাদের দেশের সমাজের জীবন নানা কারণে অত্যন্ত ক্ষুদ্র—কৃত্রিম লোকাচারের বন্ধন তো আছেই—কিন্তু ক্ষুদ্রতার আসল কারণ এদেশে কর্মক্ষেত্র নিতান্ত সংকীর্ণ— সেইটুকুর মধ্যে মানুষের বিচিত্র শক্তিকে ভালো করিয়া ছাড়া দেওয়া যায় না— তাহাতে আমাদের জীবনের লীলা ব্যাঘাত পায় বলিয়া আনন্দের অভাব ঘটে। শুধু তাই নয়। আমাদের হৃদয়ের ভাব বাহিরের ক্ষেত্রে নানারূপে আপনাকে সৃষ্টি করিতে চায় ; সেই সৃষ্টি করিতে গিয়াই সে যথার্থ পরিণতি লাভ করে, সে বল পায়, তাহার বাড়াবাড়ি সমস্ত কাটিয়া যায়, সে আপনার ঠিক ওজনটি রক্ষা করিতে শেখে—এক কথায় সে রীতিমত পাকা হইয়া উঠে। কিন্তু যে সমাজে মানুষের চিত্ত বাহিরে আপনাকে প্রকাশ করিবার এমন প্রশস্ত স্থান ও বিচিত্র অধিকার না পায়, সেই সমাজে ভাবুকতা আপনার পরিমাণ হারাইয়া ফেলে; হয়, সে অত্যন্ত ক্ষুদ্র হইয়া পঙ্গু হইয়া নিতান্ত গ্রাম্য হইয়া থাকে, নয় সে আপনাকে অসংগতরূপে স্ফীত করিয়া অদ্ভুত প্রমত্ততার মধ্যে ছুটিয়া যায়। যেখানে জীবনের ক্ষেত্র দূরবিস্তৃত সেখানে মানুষের কল্পনা নিয়তই সত্যের সংস্রবে আপনাকে সুবিহিত আকার দান করিতে পারে—যতদূর পর্যন্ত তাহার শক্তির অধিকার ততদূর পর্যন্ত সে ব্যাপ্ত হয় এবং কোন্খানে তাহার সীমা তাহাও আবিষ্কার করিতে তাহার বিলম্ব ঘটে না । সংগীত, শিল্প, চিত্রকলা, সৌন্দর্য, মানুষের সঙ্গ, ভাবের আলোচনা, শক্তির স্ফূর্তি প্রভৃতি জিনিস বাহির হইতে ক্রমাগত উত্তাপ দিতে থাকিলে আমাদের প্রকৃতি যে শোভায় সৌন্দর্যে একটি আশ্চর্য বিকাশ লাভ করিতে পারে, তাহা আমরা অন্য দেশের অন্য কবিদের জীবনচরিতে দেখিয়াছি। কেবল আমাদেরই দেশে এ সকলের অভাব যে কত বড় অভাব এবং এই সকল প্রাণের উপকরণ হইতে বঞ্চিত হইয়া থাকা যে কত বড় শূন্যতা তাহা আমরা ভালো করিয়া অনুভব করিতেও পারি না ।