ভাষা ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে ‘আনন্দ’-স্বরূপিণী-তে যে নতুন পরীক্ষা করতে গিয়েছি অনধিকারী আমার পক্ষে তা নিতান্ত দুঃসাহস। তদানীন্তন বাতাবরণ সৃষ্টি করতে সংস্কৃতজ তৎসম ও তদ্ভব শব্দ আমার কাছে অপরিহার্য ছিল, অথচ এ-কালের পাঠক ক্রিয়াপদে তথাকথিত লিখিত-বাঙলায় অনভ্যস্ত। বঙ্কিম অথবা রমেশচন্দ্রের ভাষায় ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা যুগোপযোগী নয় ৷ শরদিন্দু ভাষাকে পূর্বসূরিদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত সরল করেই তাঁর অনবদ্য ঐতিহাসিক কাহিনীগুলি রচনা করেছিলেন; যদিও ক্রিয়াপদগুলি অধিকাংশ গ্রন্থেই কথ্যরূপ পরিগ্রহ করেনি। সুবোধ ঘোষ মশাই তাঁর ‘ভারত- প্রেমকথা'য় সে দুঃসাহস দেখিয়েছেন—কিন্তু সেখানে বাতাবরণ ঐতিহাসিক নয়, পৌরাণিক। আমার পূর্বতন গ্রন্থ ‘অজন্তা-অপরূপা' সম্বন্ধেও ঐ একই কথা। তারও পূর্বে ‘মহাকালের মন্দিরে' আমি ছিলাম সম্পূর্ণভাবে শরদিন্দুর ভাষা-অনুসারি। ফলে এ গ্রন্থ রচনায় মাঝে মাঝে আমাকে সেই জাতীয় সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে, যাকে বলা হয় 'শবপোড়া-মড়াদাহ' জাতীয় সমস্যা। সংস্কৃত-সাহিত্যে অসাধারণ পাণ্ডিত্য আছে এমন একজনের দ্বারস্থ হওয়া গেল— বন্ধুবর শ্রীঅনন্তলাল দেবশর্মা (ঠাকুর)। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর নির্দেশ ডাকবিভ্রাটে যখন পেলাম তখন এ গ্রন্থ আধাআধি ছাপা হয়ে গেছে। প্রসঙ্গত তিনি লিখেছিলেন : ‘ইংরাজীতে মূল সংস্কৃত base-গুলিকে অবিকৃত রাখিয়া তাহার উপর বিভক্তি যোগ করা হয়। বাঙলায় অনুরূপ করা ভাল দেখায় না, তাই ‘বুদ্ধযশার’ ‘বুদ্ধযশাকে’ প্রভৃতি বাঞ্ছনীয়। ‘বুদ্ধযশস্-এর’, ‘বুদ্ধযশকে’ নহে। এ নির্দেশ সংশোধনের সুযোগ বর্তমান সংস্করণে প্রথমাংশে হয়নি। আরও কয়েকটি বানান ও ভাষাগত পরিবর্তনের নির্দেশ তিনি পাঠিয়েছেন যা করতে পারিনি। তাঁর শ্লোকে একটি বর্ণাশুদ্ধি হয়েছে ছাপার ভুলে—কথাটা ‘ত্বদ্বজ্রপাতং’, তদ্বজ্ৰপাতং নয়। এ কাহিনীর সংক্ষিপ্ত অংশ পূজা-সংখ্যা ‘শিলাদিত্য' ১৩৮৪-তে প্রকাশিত হয়। সেটি পাঠ করেই শ্রীঅনন্তলাল ঠাকুর ঐ চিঠি আমাকে লেখেন। তাঁর রচিত শ্লোকের জন্য আমি পূজা সংখ্যায় কৃতজ্ঞতা স্বীকার করায় ঐ পত্রে তিনি লিখেছিলেন :
Narayon Sanyal ( ২৬শে এপ্রিল, ১৯২৪ - ৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০০৫) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত লেখক। এছাড়াও তিনি একজন পুর প্রকৌশলী । নিত্য নতুন বিষয়বস্তু নির্বাচন ছিল তাঁর রচনাশৈলীর এক বৈশিষ্ট্য। লেখকের আদি নিবাস নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর। তিনি কৃষ্ণনগর কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র ছিলেন। স্কুলের খাতায় নাম ছিল নারায়নদাস সান্যাল। ১৯৪৮ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি.ই. সম্পন্ন করেন। তিনি ইন্সটিট্যুট অব ইঞ্জিনিয়ার্স (ইন্ডিয়া)-এর ফেলো ছিলেন। ১৯৮২ সালে সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নিয়েছিলেন। সাহিত্যজগতে নারায়ন সান্যাল তাঁর বকুলতলা পি এল ক্যাম্প ও দন্ডক শবরি গ্রন্থের জন্য বিশেষভাবে পরিচত। পি.ডব্লু.ডি তে চাকরি করাকালীন দণ্ডকারণ্য অঞ্চলে তাঁর পোস্টিং হয়, জীবনের অভিজ্ঞতায় এই দুটি উপন্যাস লেখেন যা বিদগ্ধ পাঠক মহলে সমাদৃত হয়। এছাড়া বিজ্ঞান, শিল্প স্থাপত্য ভাস্কর্য ও সামাজিক, ঐতিহাসিক উপন্যাস প্রচুর লিখেছেন। শিশু কিশোরদের জন্যেও তাঁর রচনা সুখপাঠ্য। তাঁর অন্যান্য রচনাগুলির মধ্যে বিশ্বাসঘাতক, ষাট একষট্টি, হে হংসবলাকা, নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা, আবার যদি ইচ্ছা করো, অরণ্য দন্ডক, অশ্লীলতার দায়ে, না মানুষের পাঁচালী উল্লেখযোগ্য। রহস্য গোয়েন্দা কাহিনীও লিখেছেন, তাঁর কাঁটা সিরিজ নামে খ্যাত বইগুলির মূল চরিত্র ব্যারিস্টার পি কে বাসু স্ট্যানলি গার্ডেনারের প্যারি ম্যাসন এর আদলে তৈরি। তার রচিত কাহিনী নাগচম্পা (যদি জানতেম), সত্যকাম, পাষণ্ড পন্ডিত চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। রবীন্দ্র পুরস্কার - অজন্তা অপরূপা-১৯৬৯, বঙ্কিম পুরস্কার - রূপমঞ্জরী-২০০০, পুরস্কারে ভূষিত হন।