এক সময় কেবল ভ্রমণ করিতাম। এই সময়টি ছিল জীবনের একটি বিশিষ্ট কাল, যখন মুক্তভাবে নানা সম্প্রদায়ের সাধুর সংস্পর্শে আসিয়া অনেকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবেই মিশিয়াছিলাম, আর আনন্দ যাহাকে বলে তাহার প্রকৃত আস্বাদ পাইয়াছিলাম। আজ এক প্রচ্ছন্ন অবধূতের কথা বলিতেছি—যাহার জন্ম-বিবরণ যেমন অদ্ভুত, কর্ম ও ধর্ম জীবনও তেমনি আলােকময়। প্রয়াগে তাহার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, তখন হইতে প্রায় দুই মাস কাল পশ্চিমাঞ্চলে নানাস্থানে তাহার সঙ্গ পাইয়াছি। সেই সময় তাহার নিজ মুখে জন্ম এবং জীবনকথা যেরূপ শুনিয়াছিলাম প্রথমে সংক্ষেপে আমার নিজের কথায় তাহা বলিয়া, পরে তাহার বিচিত্র ধর্ম-জীবনের কথা বলিবার চেষ্টা করিব। প্রায় ষাট-পঁয়ষট্টি বৎসর পূর্বের কথা, তখনও হাঁটাপথে এবং নৌকাযােগে অনেক তীর্থে যাতায়াত চলিত, রেলপথ হয় নাই। সে সময় নবদ্বীপেও নৌকাযােগেই যাতায়াত চলিতেছিল। তখন ফাল্গুন মাস, দোলের উৎসব—বাংলার নানা স্থান হইতে বৈষ্ণব-ভক্তেরা আসিয়া মহাউৎসবে যােগ দিয়াছে। নানা স্থান হইতে প্রসিদ্ধ কীর্তনিয়া আসিয়াছে, মহাপ্রভুর মন্দিরে নিত্য কীর্তন গান ও ভাগবত পাঠ চলিতেছে। পথের ধারে মেলা বসিয়াছে। মােট কথা তখনকার ক্ষুদ্র নবদ্বীপ নগরটি আনন্দের রােলে দিবারাত্র মুখরিত,—সেই সময় একদিন প্রাতে গঙ্গাতীরে এক বিস্ময়কর ঘটনা! পূর্ববঙ্গ, ঢাকা অঞ্চলের এক বণিক পরিবার তখন নবদ্বীপে থাকিত। ধনবান ও ধার্মিক বলিয়া তাহাদের খ্যাতি কর্তা পরম বৈষ্ণব, নামটি তাহার বৃন্দাবন সাহা। এখানে তাহার একটি কারবার ও একখানি পাকা বাড়িও ছিল। এই সময়টিতে প্রতি বৎসর এখানে আসিয়া চার-পাঁচ মাস সপরিবারে বাস করিত। প্রত্যহ ভােরে গঙ্গাতীরে কতক্ষণ ভ্রমণ করিয়া সূর্যোদয় হইলে স্নান-আহ্নিক শেষ করিত,তারপর গৌরাঙ্গমন্দিরে যাইয়া দর্শনাদির পর বাড়ি আসিয়া বিষয়-কর্মে মনােনিবেশ। ইহাই তাহার নিত্যকার নিয়ম ছিল। এখন এই দোল-পূর্ণিমার উৎসবের সময় একদিন ভােরে বৃন্দাবন গঙ্গাতীরে আসিয়াছে, তখন পূর্বদিক বেশ ফর্সা হইয়াছে—তবে গাছপালায়, ঝােপেঝাপে অন্ধকারও কতকটা আছে। এখনকার মত তখন এতটা চর হাঁটিয়া জলে যাইতে হইত না, কারণ গঙ্গা তখন নিকটেই ছিল। বৃন্দাবন অন্যমনস্ক হইয়া চলিতেছিল,হঠাৎ নিকটে কোথাও শিশুর কান্নার মত একটা আওয়াজ তাহার কানে আসিল। স্থির হইয়া শুনিলে বােধ হয় ঠিক।