আজ চোদ্দ-পনেরো বছর আগের কথা। কি তারও বেশী হবে হয়তো। আমার বধ, রমেশবাব, আর আমি দুজনে কলকাতার মেসে একঘরে আছি বহুদিন। ভালো লাগে না এ রকম কলকাতায় পড়ে থাকা । দেশেও তখন যাওয়ার নানারকম অসুবিধা ছিল। কিন্তু একট, বাইরে না বেরলে ধূলো আর ধোঁয়ায় প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। রমেশবাব্দকে বললাম—চলন কোথাও বেড়িয়ে আসি। রমেশবাবর ট্যাঁকের অবস্থাও খুব ভাল নয় আমার চেয়ে। তিনি অবাক হয়ে চেয়ে বললেন—বেড়াতে যাবো কিন্তু হাতে টাকাকড়ি কই— —টাকাকড়ি লাগবে না— —বিনা টিকিটে গিয়ে জেল খাটবো নাকি ? রেলে চড়ে নয়, পায়ে হেটে। —কতদূর যাবেন পায়ে হেটে ? তাঁকে বুঝিয়ে বললাম—বেশীদুর মোটেই নয়। ব্যারাকপুরে ট্রাঙ্ক রোড দিয়ে বার হয়ে পায়ে হেটে যতদূর যাওয়া যায়। কি করবো যখন হাতে পয়সা নেই, এ এছাড়া তখন উপায় কি? তিনি কি মনে করে রাজি হয়ে গেলেন। হাঁটতে হাঁটতে বারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডের ধারে একটা বাগানবাড়িতে আমরা কিছুক্ষণ বসি। বাগানের উড়ে মালী এসে আমাদের সঙ্গে খানিকটা গল্প করে গেল। তাকে দিয়ে আমরা বাগানের গাছ থেকে ভালো কাশীর পেয়ারা পাড়িয়ে আনলাম। সে ডাব পেড়ে দেওয়ারও প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু তাতে দেরি হবে বলে আমরা রাজি হইনি। ডানদিকের একটা পথ ধরে আমরা বড় রাস্তা ছেড়ে দিলাম। অনেকদিন পরে কলকাতা থেকে বার হয়েছি—কতদূর আর এসেচি, না হয় মাইল পাঁচ-ছয় হবে—কিন্তু যেন মনে হচ্ছে কতদূর এসে গিয়েছি কলকাতা থেকে স্বপ্নপরীর দ্বারে এসে পৌঁছে গিয়েছি যেন। প্রত্যেক বন ঝোপ যেন অপূর্ব্ব, প্রতিটি পাখীর ডাক অপৰ্ব্ব, ডোবার জলে এক-আধটা লালফল তাও অপূৰ্ব্ব । জীবনে একটা সত্য আবিষ্কার করেচি অভিজ্ঞতার ফলে। যে কখনো কোথাও বার হবার সংযোগ পায়নি, সে যদি কালেভদ্রে একটা আধট, বাইরে বেরবার সংযোগ পায়—যতটকুই সে যাক না কেন, ততটুকুই গিয়েই সে যা আনন্দ পাবে—একজন অর্থ ও বিত্তশালী Blase ভ্রমণকারী হাজার মাইল ঘুরে তার চেয়ে বেশি কিছু, আনন্দ পাবে না। কাজেই আমার সেদিনকার ভ্রমণটা এদিক থেকে দেখতে গেলে তুচ্ছ তো নয়ই—বরং আমার জীবনের মধ্যে অত্যন্ত মূল্যবান সেদিনটির আনন্দ। কারণ, আসলে দেখে চোখ আর মন । যখন ওই দুটি ইন্দ্রিয় বহুদিন ব,ভুক্ষ,, তখন যে কোন মুক্ত স্থান, সামান্য একটা বাঁশঝাড়, একটি হয়তো ধানের মরাইওয়ালা গৃহস্থবাড়ি, আঁকা-বাঁকা গ্রাম্য নদী, কোথাও একটা বনের পাখীর ডাক—মধর, স্বপ্নময় হয়ে ওঠে। পয়সা যাদের আছে, খুব ঘুরে বেড়াতে পারে তারা—ভালো কথাই, কিন্তু Blase' হবার ভয়ও যথেষ্ট। তখন ভীম নাগের সন্দেশও মুখে রোচে না । পরবর্ত্তীকালে জীবনে অনেক বেড়িয়েচি, এখনও বেড়াই—পাকা Blase টাইপ অনেক দেখেছি, যথাস্থানে তাদের গল্প করবো।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।