'সেরা বিদুষক' বইয়ের ফ্লাপের লেখা প্রমথনাথ বিশী বলেছিলেন, এই বঙ্গভূমে, দাদাঠাকুর ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শেষ প্রতিনিধি। একটি ধুতি, উত্তরীয়, শীতকালে বড়াে জোর একটি গরম চাদর, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সর্বদা খালি পা—এই ছিল তার চিরাচরিত মূর্তি। এনট্রান্স; পাশ করার পর অর্থাভাবে এফ. এ ক্লাসে ভর্তি হয়েও পড়াশােনা চালাতে পারেন নি। পরের অধীনে কাজ করবেন না, এই সঙ্কল্প নিয়ে সামান্য অর্থ সম্বল করে হাতে-চালানাে ছাপাখানা স্থাপন করেন জঙ্গীপুরে। এখান থেকেই বেরােয় তার সম্পাদনায় ‘জঙ্গীপুর সংবাদ পরে এই ছাপাখানা থেকেই প্রকাশিত হতে থাকে বিখ্যাত ‘বিদূষক’ পত্রিকা। ছাপাখানার তিনি নিজেই ছিলেন কম্পােজিটর, প্রুফরীডার, মেশিনম্যান সব কিছু। দাদাঠাকুর ও তার ‘জঙ্গীপুর সংবাদ এবং ‘বিদষক’ পত্রিকা দুটি ছিল সমস্ত রকম সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্যায়ের মূর্ত প্রতিবাদ। রঙ্গ-ব্যঙ্গে ভরা “বিদূষক’ পত্রিকার সংবাদ-পরিবেশন তদানীন্তন বাংলার সেরা রসিক সমাজের প্রভূত দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সরসতা, পানিং-দক্ষতা ও শাণিত বিদ্রুপ বাক্যে ভরা সব নিয়ে পরিপূর্ণ বিদূষক’ বাংলার পাঠক মাত্রকেই পরিতুষ্ট করত। বিদূষক’-এ প্রকাশিত বাছাই করা মন্তব্য, কবিতা, সংবাদ, ছড়া এই সব নিয়েই প্রকাশিত হল এই সেরা বিদূষক”। এই গ্রন্থ সজীব সবাক দাদাঠাকুরের মূর্ত প্রতিচ্ছবি। দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের জন্ম ১৮৮১ সালের ২৭শে এপ্রিল, তিরােধান ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসেই।
শরৎ চন্দ্র পণ্ডিত (২৭ এপ্রিল, ১৮৮১ - ১৯৬৮) বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজে দাদাঠাকুর নামেই পরিচিত, তিনি ছিলেন একজন বাঙালি কথাশিল্পী ও সাংবাদিক৷ যিনি মুখে মুখে ছড়া, হেঁয়ালী ও হাস্য কৌতুক রচনা করতেন। তাঁর রচিত নানান হাসির গল্প বাঙলা সাহিত্যের অমর কীর্তি৷ তার প্রকাশিত বিখ্যাত গ্রন্থ বোতল পুরাণ। জঙ্গীপুরে তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপন করতেন কিন্তু অত্যন্ত তেজস্বী মানুষ ছিলেন। চারিত্রিক দৃঢ়তায় ছিলেন আধুনিক কালের বিদ্যাসাগর। পন্ডিত প্রেস নামে একটি হস্তচালিত ছাপাখানা স্থাপন করেন তিনি। তার একক প্রচেষ্টায় জঙ্গীপুর সংবাদ নামে একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করতে থাকেন। এই পত্রিকা বাংলার বলিষ্ঠ মফস্বল সাংবাদিকতার প্রথম উদাহরণ। পন্ডিত প্রেসে তিনিই ছিলেন কম্পোজিটর, প্রুফ রিডার, মেশিনম্যান। সমস্ত কিছুই একা হাতে করতেন। এছাড়া তার প্রকাশিত বিদুষক পত্রিকায় বেরতো তাঁর নিজের রচিত নানা হাসির গল্প ও হাস্য কৌতুক। বিদূষক পত্রিকা রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষন করে। দাদাঠাকুর নিজে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় গিয়ে বিক্রি করতেন এই পত্রিকা। প্রাক স্বাধীনতার সময় কলকাতার রাস্তায় গান গেয়ে বোতল পুরান পুস্তিকাটি ফেরি করতে গেলে ব্রিটিশ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে আসে, তাঁদের জন্য তৎক্ষণাৎ বানিয়ে ইংরেজিতে গান ধরলেন তিনি। শ্বেতাঙ্গ পুলিশ খালি গা ও খালি পায়ের এমন এক হকারকে ইংরেজিতে গান গাইতে দেখে হতবাক হয়ে যায় এবং শুধু উৎসাহ জোগাতেই আট কপি কিনে নিয়ে তার কাব্যপ্রতিভা, রসবোধ ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছিল সহজাত। ইংরেজি ভাষাতে যে প্যালিনড্রোম বা উভমুখী শব্দ আছে সেরকম বাংলায় শব্দ সৃষ্টি করেছেন। হিন্দি ও ইংরেজিতেও কাব্য লিখেছেন তিনি। তার ব্যাঙ্গাত্বক কবিতাগুলি ছিল সমাজের অত্যাচারী কুপ্রথার বিরুদ্ধে জলন্ত প্রতিবাদ স্বরূপ। স্বয়ং নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাকে শ্রদ্ধা করতেন।