”তিথি” বইটির সম্পর্কে কিছু কথাঃ এই গল্প এক কিশােরী মেয়ের গল্প। গল্পের সেই মেয়েটির নাম তিথি। বয়স চোদ্দ। বাবা বিপ্লব দত্ত এবং মা মিলি দত্ত। তিথির বড় বােন সঞ্চারি এবং একমাত্র ভাই বুক্কা। বুক্কাও তিথির বড়। অর্থাৎ এই পরিবারে তিথি সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। পরিবার বেশ ভালাে ভাবেই চলছিলাে। তিথিদের নিজস্ব একটা বাড়ি আছে। অনেক বড় আর ভীষণ সুন্দর একটা বাড়ির মালিক তারা। তিথির বাবার বেশ কিছু ব্যবসায় আছে। বড়লােক না হলেও তিথিরা বড়লােকের মতােই থাকতাে। যা দরকার তার চেয়েও বেশি পেতে অভ্যস্ত সঞ্চারী, বুক্কা, তিথি। এই চলার পথে বাধাঁ পড়লাে বিপ্লব দত্ত মানে তিথির বাবার মৃত্যুর পর। তিথির বাবা মাস দুয়েক আগে সুইসাইড করেছেন। কোনরকম সুইসাইড নােট লিখে যান নি বিধায় কোন নির্দিষ্ট কারণ পুলিশ বের করতে পারে নি। বাবার অবর্তমানে এতাে বড় বাড়িটা যেন আরাে গুমােট হয়ে উঠলাে তিথির কাছে। বয়সের অনুপাতে তিথি একটু বেশিই গম্ভীর আর চুপচাপ স্বভাবের। মা এবং দুই ভাই-বােনের সাথেও দরকার ছাড়া কোন কথা নেই তিথির। ওর সমস্ত স্বত্ত্বাটা জুড়ে ছিলাে বাবা। বাবা মারা যাওয়ার মামা সােমনাথের মাধ্যমে জানা গেলাে বিপ্লব দত্তের কোন সম্পত্তি না থাকলেও অসংখ্য ধার-দেনা আছে। এই বাড়িটুক ছাড়া আর কিছু নেই। এখন এই বাড়ি বেচে ঋণ শােধ করতে হবে। বাড়ি বেচাঁর পক্ষে না থাকলেও নিজেদের কথা ভেবে রাজি হতে হলাে মিলি দত্ত এবং তিথি, সঞ্চারি, বুক্কার। কিন্তু বাড়ি বেচতে গিয়েও দেখা গেলাে এই বাড়ির নামেও লােন নিয়েছিলাে বিপ্লব দত্ত। পুরােপুরি পথে বসার উপক্রম এখন তিথির পরিবারের। এখন কি হবে? পরিত্রাণের কি আদৌ কোন উপায় মিলবে নাকি এভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে তিথিদের? সেই গল্প নিয়েই শীর্ষেন্দু মুখােপাধ্যায়ের "তিথি"!
পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ১৯৩৫ সালের ২রা নভেম্বর বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের টালমাটাল সময়ে পরিবারসমেত কলকাতা পাড়ি জমান। বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় শৈশব কেটেছে তার। কোচবিহার বোর্ডিং স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন তিনি। মাধ্যমিক পাস করেন কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে। পরে কলকাতা কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। শীর্ষেন্দু তার পেশাজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মাধ্যমে। দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকতাও করেছেন কিছুদিন। বর্তমানে সাহিত্য পত্রিকা দেশ-এর সহকারী সম্পাদক পদে নিয়োজিত আছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ছোটবেলা থেকেই ভীষণ বইপড়ুয়া ছিলেন। হাতের কাছে যা পেতেন তা-ই পড়তেন। খুব ছোটবেলাতেই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানিক বন্দোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দোপাধ্যায় এর মতো লেখকদের রচনাবলী পড়ে শেষ করেছেন। এই পড়ার অভ্যাসই তার লেখক সত্ত্বাকে জাগিয়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে দেশ পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ‘জলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হয়। দীর্ঘ ৭ বছর পর দেশ পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘ঘুণপোকা’। এরপর থেকেই নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই এর সংখ্যা দু’শতাধিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস পার্থিব, দূরবীন, মানবজমিন, গয়নার বাক্স, যাও পাখি, পারাপার ইত্যাদি। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর রহস্য সমগ্র রহস্যপ্রেমীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রায় ৪০ এর অধিক রহস্য গল্প প্রকাশিত হয়েছে ‘অদ্ভুতুরে সিরিজ’ নামকরণে। মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি, ভুতুড়ে ঘড়ি, হেতমগড়ের গুপ্তধন, নন্দীবাড়ির শাঁখ, ছায়াময় ইত্যাদি এই সিরিজের অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু ছোটগল্প রচনা করেছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমূহ দুই বাংলায় পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সমানতালে। এছাড়াও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এর বই সমগ্র অবলম্বনে বিভিন্ন সময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। তার উপন্যাস ‘যাও পাখি’ এবং ‘মানবজমিন’ নিয়ে বাংলাদেশেও ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে। তার সৃষ্ট চরিত্র শাবর দাশগুপ্ত এবং ধ্রুব পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা উপন্যাস ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র জন্য ১৯৮৫ সালে ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’ পান। ১৯৭৩ এবং ১৯৯০ সালে পেয়েছেন ‘আনন্দ পুরস্কার'। ১৯৮৮ সালে ‘মানবজমিন’ উপন্যাসের জন্য অর্জন করেন ‘সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার’। এছাড়াও, ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদত্ত সম্মান ‘বঙ্গবিভূষণ’ লাভ করেন তিনি।