“সেরা কিশোর গল্প" বইটির ফ্ল্যাপ এর লেখাঃ উপন্যাসের জন্য তাকে সবাই এক নামে চেনেন। কিন্তু এই প্রতিভাবান লেখকের যে ছােটগল্পেও ছিল অসামান্য হাত, তার খবরটা সেই পরিচয়ে অনেকটাই চাপা । অতসীমামী’, ‘ছােটবকুলপুরের যাত্রী ‘প্রাগৈতিহাসিক’, সংকলনের গল্পগুলাে যে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা না-পড়লে জানা অসম্ভব। বিয়াল্লিশটি উপন্যাসের সঙ্গে এই। কথাশিল্পী লিখেছেন দুই শতাধিক ছােটগল্প । সুতরাং গল্পের পাল্লাটা অপেক্ষাকৃত কম ভারী নয়। তার পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মানদীর মাঝি বেশ সমাদৃত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃত নাম প্রবােধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক। মূল্যবােধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথা-সাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে। সাহিত্যজগতে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা। সূচিত হয়, তাদের অন্যতম মানিক। বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর রচনার মূল বিষয় মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, মানুষের শ্রমসংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব। দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁর রচনায় সেই ছাপ রয়েছে। পৃথিবীর অনেক ভাষায় এই মহান লেখকের। লেখা অনূদিত হয়েছে। তার লেখালেখির গল্পও খুব মজার। একদিন কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডা দিতে গিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে বাজি ধরলেন। তা হলাে, নিজের লেখা গল্প বিচিত্রায়। ছাপাবেন। বলে রাখা ভালাে, সে সময় কলকাতায় বিচিত্রা পত্রিকা ছিল অত্যন্ত। বিখ্যাত এবং কেবল নামকরা লেখকেরাই সেখানে লিখতেন। বন্ধুর সাথে বাজি ধরে। মানিক লিখে ফেললেন তার প্রথম গল্প অতসীমামী এবং সেটি বিচিত্রার সম্পাদক বরাবর পাঠিয়ে দিলেন । গল্পের শেষে নাম সাক্ষর করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। হিসাবে। পাঠানাের চার মাস পর ছাপা হয় লেখাটি এবং ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। আর এভাবেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। নামটি পরিচিত হয়ে ওঠে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে । এরপর আর লেখা থামাননি। কিন্তু এতে তার একাডেমিক পড়াশােনার বেশ তি হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে । আর সাহিত্য রচনাকেই বেছে নেন মূল পেশা হিসেবে। হয়তাে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এটাই তার জায়গা। আর এভাবে তিনি এই বিরাট সাহিত্যঙ্গনে রাজত্ব করে বেড়াবেন । করেছেনও তাই । তার লেখাগুলাে এখনাে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ। সেই লেখকের কিশাের গল্পগুলাে থেকে নির্বাচিত কিছু গল্প একসাথে। করা হলাে এই বইয়ে। গল্পগুলাে যেমন মানবিকতার শিক্ষা দেয়, তেমনি ভাবনার জাগয়াটিও তৈরি করে। চলুন দেখি মানিকের কিশােরপাঠ কতটা রঙিন!
শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, নিয়তিবাদ ইত্যাদি বিষয়কে লেখার মধ্যে তুলে এনে বাংলা সাহিত্যে যিনি অমর হয়েছেন, তিনি হলেন প্রখ্যাত ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯০৮ সালের ১৯ মে বিহারের সাঁওতাল পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, আর মানিক ছিলো তাঁর ডাকনাম। বাবার বদলির চাকরিসূত্রে তাঁর শৈশব, কৈশোর ও ছাত্রজীবন কেটেছে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, যার ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের পটভূমিতে বিভিন্ন সাহিত্য রচনা করেছেন তিনি। প্রবেশিকা ও আইএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় গণিত বিষয়ে অনার্স করতে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে পড়াশোনাকালে বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তিনি 'অতসী মামী' গল্পটি লেখেন। সেই গল্পটি বিখ্যাত 'বিচিত্রা' পত্রিকায় ছাপানো হলে তা পাঠকনন্দিত হয় এবং তিনি সাহিত্যাঙ্গনে পরিচিত হয়ে ওঠেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি সাহিত্য রচনায় পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন, যার ফলে তাঁর পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং তিনি আর পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি। তাঁর হাতে বাংলা সাহিত্যে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় ঐ সময়ে, যখন সারা পৃথিবী জুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের এক চরম সংকটময় মুহূর্ত চলছে। কমিউনিজমের দিকে ঝুঁকে যাওয়ায় তাঁর লেখায় একসময় এর ছাপ পড়ে এবং মার্ক্সীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র। ফ্রয়েডীয় মনোসমীক্ষণেরও প্রভাব লক্ষ্য করা যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাসমগ্র-তে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে 'পদ্মানদীর মাঝি', 'দিবারাত্রির কাব্য', 'পুতুলনাচের ইতিকথা', 'শহরতলি', 'চতুষ্কোণ', 'শহরবাসের ইতিকথা' ইত্যাদি বিখ্যাত উপন্যাস, এবং 'আত্মহত্যার অধিকার', 'হারানের নাতজামাই', 'বৌ', 'প্রাগৈতিহাসিক', 'সমুদ্রের স্বাদ', 'আজ কাল পরশুর গল্প' ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা রচনার কিছু নিদর্শন থাকলেও সেগুলো তেমন উল্লেখযোগ্যতা অর্জন করেনি। অসামান্য এই কথাসাহিত্যিক মাত্র ৪৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালের ৩ ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।