অসহজ পথেই হেঁটেছেন প্রভাষ প্রভাষদাকে চিনি ২০০৬ সাল থেকে। দেশের প্রথম নিউজ চ্যানেল সিএসবি নিউজে প্রভাষদা ছিলেন বার্তাকক্ষের অন্যতম কর্ণধার। ২০১০ সালে এটিএন নিউজে আবারো প্রভাষদার সাথে আবারো কাজ করার সুযোগ হয়। একজন রিপোর্টার হিসেবে কাজ করতে গিয়ে সবসময় পেয়েছি তার নির্দেশনা, সহযোগিতা, পরামর্শ। দেখেছি তার পেশাদারিত্ব। বার্তাকক্ষের নীতিনির্ধারক হিসেবে সংবাদ নিয়ে তার ভাবনা, চিন্তা, সিদ্ধান্ত। দেখেছি ভুল ত্রুটি কেটে ছেটে একটি রিপোর্টকে কিভাবে সম্পাদনা করেছেন, সম্প্রচারের যোগ্য করে করে তুলেছেন। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে সাংবাদিকতা এবং সমকালীন বিষয় নিয়ে তার গদ্য ও প্রকাশিত গ্রন্থগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছি। এবার সবচে কঠিন গুরুভার এল কাঁধে। তার বইয়ের ভূমিকা লেখার দায়িত্ব। আমি শুধু এক্ষেত্রে আমার বিশ্বাসের কথাই বলব। পাঠককে কিভাবে আক্রান্ত করতে হয় তা জানা থাকা চাই লেখকের। প্রভাষ আমিন তা বেশ ভালো জানেন। তার গদ্য ঝরঝরে, ভাষা সাবলীল, মেদহীন। সব ধরনের পাঠককে স্বাগত জানান, দরোজা খুলে রাখেন সমালোচকদের জন্যও। শব্দকে শাসনে রেখে নিজের কথাটি অনায়াসে কিভাবে বলতে হয় তার কৌশল তার জানা। একজন দক্ষ কথাশিল্পীর মতই তার বাচনভঙ্গি, শব্দের গাঁথুনি। সম্ভবত তিনি একসময় কবিতা লিখে হাত পাকিয়েছেন। বিচিত্র পাঠাভ্যাসের মাঝে বেড়ে উঠেছেন। আমার বিশ্বাস সাংবাদিকতা, সাম্প্রতিক সমকালীন বিষয় নিয়ে প্রবন্ধ গদ্যের পাশাপাশি কথাসাহিত্যে মন দিলে পাঠক আবিস্কার করবেন নতুন এক লেখককে। তার এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ ‘স্বাধীনতা আমার ভালো লাগে না’, ‘প্রধানমন্ত্রীই যেখানে অসহায়’ এবং ‘রাজাকারের ফাঁসি সারা বাংলার হাসি’ তিনটি গ্রন্থেই লেখক হিসেবে তার পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণের ক্ষমতার সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে পাঠকের। শব্দের পর শব্দে কথার মালা গেঁথে বিষয়কে এমনভাবে টেনে নিয়ে যান যে লেখার দৈর্ঘ্য তখন আর বড় হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে অনায়াসপাঠ্য। আর বিষয় বৈচিত্রে ও গতানুগতিক চিন্তার বদলে ভিন্ন দৃষ্টি তার লেখাকে দিয়েছে ভিন্নমাত্রা। সমকালীন, সামাজিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখা অনেকটাই ঝুকিপূর্ণ কাজ। সাহসেরও বটে। কারণ প্রচলিত মত ও পথের বাইরে গিয়ে নিজের যুক্তি উপস্থাপনের ফলে অন্যের মতের সঙ্গে দেখা দেয় দূরত্ব, অমিল। এই ঝুঁকিটা স্বেচ্ছায় নিয়েছেন তিনি। ‘স্বৈরাচারের দালাল বলছি’ গ্রন্থে উঠে এসেছে নানা বিষয়। ক্ষমতাসীন দল, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, ছাত্রলীগ, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধাপরাধের বিচার, বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন তাতে অনেকটাই বস্তুনিষ্ঠ, কখনো কখনো সত্যের কাছাকাছি থাকার কারণে তাদের ভুল ত্রুটিগুলোও উঠে এসেছে। পাশাপাশি বিএনপির রাজনীতি, হরতাল অবরোধ, বেগম খালেদা জিয়ার আন্দোলনের কৌশল, তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্য নিয়ে লেখা গদ্যে একজন গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক হিসেবে লেখার বস্তুনিষ্ঠতা, সততা বজায় রাখার চেষ্টা করেছেন। জামায়াত, জাতীয় পার্টির রাজনীতি, গণমাধ্যম নিয়েও তার বক্তব্য স্পষ্ট, নির্মোহ। এই লেখাগুলো হয়ে উঠেছে সমকালীন রাজনীতি, সামাজিক বিষয়ের প্রামাণ্য দলিল। এই গ্রন্থটিও পাঠকের গ্রনগযোগ্যতা পাবে, আস্থা কুড়াবে এ কথা বলাই যায়। নিজের মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণকারীদের কথাও তিনি বেশ সাদরে গ্রহণ করেন। নির্মোহ থেকে নিজের কথাটি বলে যাওয়া, অনেকের কাছে অজনপ্রিয় হওয়ার আশঙ্কাকে জিইয়ে রেখে, সহজ কথা নয়। প্রভাষ আমিন সেই অসহজ পথেই হেঁটেছেন। দ্বিমত পোষণকারীদের মতামত বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণ করে তর্ককে জিইয়ে রাখার সুযোগ দিয়েছেন যা তার নিরপেক্ষতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। রাজনীতি বিশ্লেষক, একজন গনমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, একজন তাত্ত্বিক, তার লেখকসত্ত্বার পরিপুরক হয়ে উঠেছে। তার লেখায় পাওয়া যায় নতুন চিন্তার ঝলক। সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষন হয়ে ওঠে বিশ্বাসযোগ্য এক সামাজিক কণ্ঠস্বর। তার চিন্তার মৌলিকতা, স্বচ্ছতা পাঠককে তার লেখার সাথে একাত্ম হতে সহায়তা করে। যেকোনো বিষয়কে তিনি তার নিজের সিদ্ধান্তের পরিণতি পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান যৌক্তিক ব্যাখ্যা, পরিণত বিশ্লেষণ এবং পরিমিতি বোধ দিয়ে। সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যের সাথে যুক্ত আছি বলে কোনো লেখা পড়ে টের পাই লেখকের ক্ষমতা। কয়েকটি গ্রন্থে প্রভাষ আমিন নিজের কলমের শক্তি, যাকে বলে কব্জির জোর দেখিয়ে দিয়েছেন। একজন শক্তিমান লেখকের প্রতি এই অভাজন অনুজের নিরন্তর শুভেচ্ছা। জাহানারা পারভিন