ভূমিকা বিখ্যাত গায়ক ভূপেন হাজারিকা একটি গান গেয়েছিলেন, ‘সংখ্যালঘু কোনো সম্প্রদায়ের, ভয়ার্ত মানুষের না ফোটা আর্তনাদ যখন গুমরে কাঁদে আমি যেন তার নিরাপত্তা হই।’ ছাত্রজীবন থেকেই গানটি আমাকে অনেক ভাবিয়েছে। আমি নিজেও এই গান গেয়েছি নানা অনুষ্ঠানে। এখনো সুযোগ পেলে এই গান গাই। আজ এতদিন পর আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রের অবস্থা দেখে, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী মানুষের অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রের উপেক্ষা ও অবহেলা দেখে, মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের নিষ্ঠুরতা দেখে গানটির অর্থ আরো গভীরভাবে আমাকে ভাবায়। আমরা এমন রাষ্ট্র চাইনি। কবি শামসুর রাহমান লিখেছিলেন, ‘কথা ছিল প্রত্যেককে দেখাব অনিন্দ্য সূর্যোদয়, পায়রা উড়িয়ে দেব মেঘের কিনারে।’ সেটি আর হয়নি।
আমি নিয়মিত লেখালেখির জগতে আসি ১৯৯৩ সালের পর। ১৯৯৪ সালে আমি নিয়মিত কলাম লিখি। কলামের নাম ‘আদিবাসী মেয়ে’। ওই কলামগুলো নিয়ে বই বেরিয়েছে এবং বইটির চতুর্থ সংস্করণ হয়তো শেষ হয়ে গেছে। অবশ্য নব্বইয়ের শুরুতেই আমি আদিবাসী অধিকার নিয়ে লেখা আরম্ভ করি। আমার লেখা পড়ে, গ্রামের দূর থেকে বাবা চিঠি লিখেছেন আতঙ্কিত হয়ে, আমি যেন সংখ্যালঘু মানুষের দুঃখকষ্টকে নিয়তি বা ভাগ্য বলে মেনে নেই। প্রিয় সন্তানের প্রাণের কথা চিন্তা করে, আর দেশের বাস্তবতা বিবেচনা করে বাবা চিঠি লিখেছিলেন। তার অভিজ্ঞতা ও ধারণা হলো, আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলা এখানে সহজ নয়, নিরাপদও নয়। আমি বাবাকে বলতাম, বোঝাবার চেষ্টা করতাম- আমি যা বলছি ও লিখছি সব মানুষের অধিকারের অংশ, মানবাধিকারের অংশ। তিনি নিশ্চয়ই তাতে শান্তি পেতেন না। আমাদের রাষ্ট্র, তার সরকারসমূহের নিষ্ঠুর চরিত্র, রাজনীতির অন্ধকার দিক, ন্যায়বিচারের চেহারা, সামাজিক অবক্ষয় ইত্যাদি দেখে বাবা চেয়েছিলেন তার সন্তান ‘সংখ্যালঘু’ সমাজের একজন হিসেবে এই দুঃখকষ্ট ও বঞ্চনার বেদনাকে ‘নিয়তি’ হিসেবেই নীরবে মেনে নিয়ে সহজ সুন্দর জীবনযাপন করুক, তবু ছেলেটি নিরাপদে বেঁচে থাকুক। সেটি আর হয়নি আমার জীবনে। ২০১০ সালের ২২ জানুয়ারি নেত্রকোনার রানীখংয়ে যখন আমাকে আক্রমণ করা হলো, আমার বাবার কথা মনে পড়ল। কত কিছুই তো হতে পারতো সেদিন। আমার মৃত্যু হতে পারতো অথবা চিরতরে আমাকে হয়তো বা মেরে পঙ্গু বানাবার নির্দেশ ছিল। জীবনে হয়তো কিছু পুণ্যের কাজ করেছিলাম, তাই সেদিন বেঁচে ফিরে এসেছিলাম। মনে পড়ে, এই জীবনে অনেক মানুষের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করেছি। একদিন কোনো এক আদিবাসী গ্রামে গেছি, অচেনা একজন মাঝবয়সী নারী এসে বললেন, তুমি আমার এই উপকার করেছিলে এত বছর আগে। ওই নারীর চোখ ছলছল। এইসব মায়াভরা মানুষদের দূরের নীরব আশীর্বাদেই হয়তো আমার বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি সেদিন। তারপরেই আমার ওই কলাম, ‘আমি জীবনে জীবন মেলাবার কথা বলেছিলাম’ লিখেছিলাম প্রথম আলোতে।
এই বইয়ে প্রকাশিত সকল লেখাই বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বেশিরভাগ লেখাই প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোতে। এজন্য কিছু কিছু বিষয় পুনরাবৃত্তির মতো মনে হবে। প্রিয় পাঠক পড়ার সময় নিজগুণে তা বুঝতে পারবেন। বইটি প্রকাশের সময় এবং কলাম লেখার সময় তুলি লাবণ্য ম্রং, মহতী রেমা ও পিয়া দফো প্রুফ দেখে ও নানাভাবে সাহায্য করেছেন। তাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সূচীপত্র প্রকাশনীর কর্ণধার সাঈদ বারী নানাভাবে বইটি প্রকাশে উৎসাহিত করেছেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এই জীবনে কত মানুষের কাছে ঋণ আমার, ভালোবাসার, মমতার, সঙ্গে থাকার, পাশাপাশি পথচলার আর সমর্থনের। রবীন্দ্রনাথের মতো আমিও তো সবার সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছি। ‘যুক্ত করো হে সবার সঙ্গে মুক্ত করো হে বন্ধ’, বলেছি। আমাদের জন্মভূমি, এই দেশ কত সুন্দর। আমাদের গ্রামগুলো কত সুন্দর। নদী, পাহাড়, সবুজ ধানের ক্ষেত কত সুন্দর। এ দেশের মানুষের মনে বড় বেশি আবেগ। মায়াভরা প্রাণচঞ্চল কত মানুষ এখানে। কত সামান্যতেই এ দেশের মানুষেরা খুশি। কত আনন্দ তাদের মনে। এখানে আমরা যদি জীবনের সঙ্গে জীবন মেলাবার আয়োজন করতে পারতাম, প্রিয় দেশটি আরো কত সুন্দর হয়ে উঠতো? মান্না দে গেয়েছিলেন, এ জীবন মরুসম ছিল গো, তুমি সেথা আনিলে বসন্ত, বুঝিলাম ধরণীতে রয়েছে, ‘আলো গান মাধুরী অনন্ত।’ এত মাধুরী, আলো-হাসি-গান ছেড়ে কোথায় যাব আমি? সবাইকে জানাই প্রীতি ও শুভেচ্ছা। সঞ্জীব দ্রং ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫
সূচিপত্র * ভূমিকা ৭ * আসকিপাড়ায় বড়সভা ১১ * আদিবাসী দিবসে সেতু বন্ধন ১৩ * আদিবাসী দিবসের মূল সুর আদিবাসী মিডিয়া ১৭ * স্বপ্ন ছড়িয়ে যাই ২১ * ইছামতি-বুগাই-সোমেশ্বরী-মেননেং ২৩ * হায় বিরিশিরি ৩৩ * ভরা থাক স্মৃতিসুধায় হৃদয়ের পাত্রখানি ৩৫ * অস্ট্রেলিয়ায় মান্দিরা ৪৪ * আমি জীবনে জীবন মেলাবার কথা বলেছিলাম ৫০ * খাসিয়াদের জীবন আবার বিপন্ন : বনবিভাগ ও দুর্নীতি পরস্পর ভাই? ৫৩ * নববর্ষের উপহার : আদিবাসীদের জন্য প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষণ ৫৫ * পাহাড়ের বন্ধু, যেও না দেশান্তর ৫৮ * ভাবনাপত্র : গারো প্রথাগত আইন : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা ৬১ * ক্ষুদ্র জীবন, বাকি কত কাজ ৬৪ * জীবন-নদীর গান ৭৩ * আদিবাসীবান্ধব জাতীয় বাজেট চাই ৮১ * কেঁদো না প্রিয় মাতৃভূমি মাটিরাঙ্গা ৮৭ * আদিবাসী অধিকার-উপলব্ধি ৮৯ * স্বপ্ন দেখার অধিকার ৯৭ * দি স্কাই পিপল ডু নট লার্ন ১০৪ * আমার জন্য কেঁদো না রাঙ্গামাটি ১০৮
সঞ্জীব দ্রং-এর জন্ম গারাে পাহাড়ের কোলে সংরা গ্রামে। ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি, সন্ধ্যায়। মাঘ মাসে ওই সন্ধ্যায় গ্রামজুড়ে আকাশরাঙা পূর্ণিমা ছিল। উত্তরে একটু দূরে গারাে পাহাড় বাড়ির পাশে পশ্চিমে ছােট্ট মেননেং নদী। একদিকে পূর্নিমার চাঁদ উঠছে, অন্যদিকে একটি শিশুর জন্ম হচ্ছে। আর পূর্ণিমার রাতে যে-শিশু জন্মে, তার সম্পর্কে আম্বি (নানী) উষালতা দ্রং কী যেন অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। মৃত্যুপথযাত্রী মা গ্রন্থকারকে সে কথা বলে গেছেন। বাবা সুহৃদ গাগ্রা, মা নয়নী দ্রং উভয়ে পরলােকগমন করেছেন। জীবনে গ্রন্থকারের পরিবার শরণার্থী হয়েছেন কমপক্ষে দু’বার। বালক সঞ্জীব নিজে একাত্তরে উদ্বাস্তু হয়েছেন মেঘালয়ে। এই নিয়ে তাঁর বই লেখার ইচ্ছে আছে ভবিষ্যতে।। সঞ্জীব দ্রং আদিবাসী জীবনে অনেক কঠিন সময়ের মধ্যেও বুকের ভেতর আশা জাগিয়ে রেখেছেন। তার স্বপ্ন একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে, সব মানুষ ভালাে হয়ে যাবে। সকলে আদিবাসীদের প্রতি, সকল মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও ভালােবাসা দেখাবে। পৃথিবী হয়ে উঠবে খুব সুন্দর। ইদানীং সঞ্জীব দ্রং বক্তৃতা দিয়ে বেড়ান। ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের জন্য কথা বলে আনন্দ পান। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা করেছেন। আর নরওয়ের ট্রমসাে ইউনিভার্সিটি, আমেরিকার নটরডেমে সেন্ট মেরীস কলেজ, থাইল্যান্ডের বুরাফা বিশ্ববিদ্যালয়, ওয়াশিংটন জাস্টিস, পিস এন্ড ইন্টিগ্রিটি অব ক্রিয়েশন সেন্টারসহ অসংখ্য জায়গায় বক্তৃতা করেছেন। জাতিসংঘের অধিবেশনে জেনেভা ও নিউ ইয়র্কে কথা বলেছেন। রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কানাডা সরকার, অস্ট্রেলিয়া সরকার, ইউরােপিয়ান ইউনিয়নসহ অনেকের আতিথ্য গ্রহণ। করেছেন। ইদানিং টিভি টকশােতে তাকে দেখা যায়, এখানেও তিনি সমান জনপ্রিয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি নানা সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সক্রিয় সঞ্জীব দ্রং বলেন, মানুষে মানুষে, জীবনে জীবন মেলাবার এই আয়ােজন যেন থেমে না যায়। তিনি স্বপ্ন দেখেন, বুকের মধ্যে জমে থাকা কথাগুলাে সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। পরম যত্ন ও মমতায় আদিবাসী কথাগুলাে গান ও সুর হয়ে যাবে একদিন।