বাংলাদেশের সাহিত্যের একটি শক্তিশালী রূপমাধ্যম ছোটগল্প। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এ মাধ্যমের আলোচনা সমালোচনা বিশ্লেষণ তুলনামূলকভাবে কম। তিরিশের দশক থেকেই তদানীন্তন পূর্ববাংলার ছোটগল্পের বিকাশ। এর পুরোধা যাঁরা, তাঁদের নিয়েই এই গ্রন্থ। 1947-70 সময়কালের বাংলাদেশের ছয়জন বিশিষ্ট গল্পকারের প্রত্যেকেই কথাশিল্পী হিসেবে আমাদের সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এঁদের মধ্যে একমাত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ছাড়া আর কারো সম্পর্কে কোন প্রাতিষ্ঠানিক বা বিশ্লেষণধর্মী পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচিত হয়নি। এটা সত্যিই বেদনাদায়ক। এই গ্রন্থটি সে অভাব পূরণে একটি উল্লেখযোগ্য প্রয়াস। উপরোক্ত কথাশিল্পীদের প্রতিভার মূল্যায়ন, গল্প রচনায় তাঁদের সাহিত্যিক অবদানের যথার্থ্য বিচার, বিষয় ও আঙ্গিকগত বিশিষ্টতার বিশ্লেষণ, স্ব স্ব ক্ষেত্রে অনন্যতা - এ সমস্তই খালেদা হানুম পরীক্ষা করেছেন নিরাসক্ত - মন গবেষক হিসেবে। গল্পকারগণ নিজেদের ক্ষেত্রে অনন্য আবার বাংলাদেশের গল্পের মূলধারা থেকেও বিচ্ছিন্ন নন, লেখিকা তা-ও সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি বাংলাদেশের ছোটগল্পকে বিশ্ব প্রেক্ষাপটে অবলোকন করতে প্রয়াসী হয়েছেন। সামপ্রতিককালে সাহিত্যিক মহলের কেউ কেউ মনে করেন- ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ তেমন উজ্জ্বল নয়- লেখিকা এই ধারণা ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করার প্রয়াস পেয়েছেন। খালেদা হানুম আলোচ্য ছয়জন গল্পকারের গল্পসমগ্র গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন যে, কোন রাজনৈতিক মতবাদ বা দর্শন তাঁদের রচনার প্রেরণায় সক্রিয় ছিল না বরং চিরকালীন মানবিক মূল্যবোধ তাঁদের গল্পকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। লেখিকা তাঁর আলোচ্য গল্পকারদের জীবনমানসের রহস্যের উন্মোচন ঘটিয়েছেন। অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের সৃষ্টি চরিত্র, পরিবেশ, সৃজন কতটুকু সার্থক হয়েছে, কতটা জীবনঘনিষ্ঠ হয়েছে তাঁদের বক্তব্য। কালের ধ্বনি তাঁদের গল্পে শ্রুত হয় কিনা তা দেখতে গিয়ে বের করে এনেছেন আবহমান বাংলাদেশকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পূর্ববাংলার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে তিনি দেখেছেন শুধু ক্ষুধা আর দারিদ্র্য নয়, এই ভূখণ্ডের সমাজজীবনের নানা সাফল্য ও ব্যর্থতা, গ্লানির ছবি, আছে সেই সঙ্গে কিছু সজীব চারা। শস্যবিহীন বিরাণ মাঠ যেমন আছে, তেমনি আছে শিশিরে ভেজা ফসলের আগমনের স্বপ্নও। এর কিছুই গবেষকের দৃষ্টি এড়ায় নি।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কৃতী শিক্ষক কথাসাহিত্যিক খালেদা হামের জন্ম চল্লিশের দশকে ফটিকছড়ির নানুপুর গ্রামে। তার পিতা এম, এ তাহের, মাতা রহিমা তাহের। পিতামহ মতরজ্জম আবদুস সােবাহান। প্রপিতামহ মুন্সী ফতেহ আলী। তার শিক্ষা জীবন শুরু হয় ডাক বিভাগের কর্মকর্তা পিতার কর্মস্থল মাদারীপুর । এরপর দেশ বিভাগের পূর্বে কিছুকাল ফটিকছড়ির আবু সােবাহান এইচ ই স্কুল এবং ঢাকার বাংলাবাজার বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। সেসময় কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সভায় গায়ক আব্বাস উদ্দিন, বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এর সান্নিধ্যে এসে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার অনুপ্রেরণা লাভ করেন। পঞ্চাশের দশকে তার পিতা চট্টগ্রাম ডাক বিভাগের উর্ধতন কর্মকর্তা হয়ে ফিরে এলে খালেদা হানুম ফিরে আসেন চট্টগ্রামে, ভর্তি হন অপর্নাচরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণীতে। সেসময় তিনি লেখালেখির তাগিদ অনুভব করেন। আর খালেদা হানুমের এ সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অনুপ্রেরণার জল ঢেলে গেছেন মা। বাবা এবং বড়ভাই এম এস মাহমুদ। তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় কলকাতার সত্যযুগ পত্রিকার ছােটদের মজলিশে, পাশাপাশি সংবাদের ‘খেলাঘরে। একই সময়েই ছােটদের উপযােগী দুটো নাটক লেখেন তিনি। তারই পরিচালনায় একটি চট্টগ্রামের সেন্ট স্কলাসটিকা স্কুলে অভিনীত হয়। দ্বিতীয়টিতে তিনি অভিনয় করেন। ১৯৫৪ সালে খালেদা হানুম কৃতীত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। সেসময় কলেজে প্রতিমাসের সাংস্কৃতিক বৈঠকে গল্পপাঠের আসরে তার ছিল নিয়মিত অংশগ্রহন। ১৯৫৫ সালে গল্পরচনা প্রতিযেগিতায় তিনি পুরস্কৃত হন। এতে বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাহিত্যিক আবুল ফজল। এ ছাড়া ১৯৬১ সালে তিনি চট্টগ্রামে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী ও নজরুল হীরক জয়ন্তী উৎসবে আবৃত্তি ও আলােচনায় অংশ গ্রহন করে সুধীজনের প্রশংসা অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে (ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের অধীনে) বাংলা সাহিত্যে অনার্স সহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন। '৬৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং '৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসাবে যােগদানের মধ্য দিয়ে শুরু করেন তার শিক্ষকতা জীবন।